পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানুন । “বাংলার আপেল” নামে পরিচিত পেয়ারা আর আপেলের তুলনা, কখন খাবেন, কাঁচা ও পাকা পেয়ারার গুণ এবং রোজ খেলে কী হয়? সব উত্তর পাবেন এখানে ।
পেয়ারা
: বাংলার আপেল
পেয়ারা
হলো এমন একটি ফল, যা পূর্ববঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গ দুই বাংলাতেই সারা বছর ধরে
গ্রামে-শহরে, যেকোন ফলের দোকানে বা ফুটপাতে সাধারণভাবেই খুব কম মূল্যেই পাওয়া যায়
। আর এর অসাধারণ এবং অনবদ্য টক-মিষ্টি স্বাদ, সুগন্ধ আর অসামান্য পুষ্টিগুণের জন্য
একে সাধারণ মানুষ “বাংলার আপেল” বলে থাকেন । পেয়ারা শুধু খেতেই মুখরোচক নয়, এর
মধ্যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য স্বাস্থ্য-গুণের রহস্য উপাদান । কিন্তু বিশেষ বিশেষ
ক্ষেত্রে এই ফলের ভালো এবং মন্দ দুই দিকই দেখতে পাওয়া যায় । আজকের এই ব্লগ পোস্টে
আমরা জানার চেষ্টা করবো – পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা কি, পেয়ারা খাওয়ার অপকারিতা কি,
আপেলের সাথে পেয়ারার তুলনা এবং পেয়ারা সম্পর্কে আমাদের মনে জাগা আরো কিছু প্রশ্নের
উত্তর ।
পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা কী কী?
১) রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
পেয়ারার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি পাওয়া যায় । একটি পেয়ারাতে একটি কমলার চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি ভিটামিন-সি থাকে । যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে আমাদের দূরে রাখে । বিশেষ করে বর্ষাকালে ভাইরাল-ফ্লু থেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে নিজেদের দূরে রাখার জন্য পেয়ারা খুবই কার্যকর ।
২) ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
কাঁচা পেয়ারার মধ্যে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুবই কম (মাত্র ২০-৩০), তাই ডায়াবেটিস রোগীরা নির্ভয়ে এটি খেতে পারেন । আর এর মধ্যে থাকা ফাইবার উপাদান রক্তে শর্করার শোষণ ধীর করে দিয়ে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে, পেয়ারা পাতার চা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতেও সাহায্য করে থাকে ।
৩) হজমশক্তি
উন্নত করে
পেয়ারার মধ্যে থাকে প্রচুর ফাইবার (প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯ গ্রাম)। যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে । কাঁচা পেয়ারা বদহজম এবং অ্যাসিডিটি কমাতেও কার্যকরী ভূমিকা নেয় । পেয়ারা পাতার রস পান করলে পেটের প্যারাসাইটস (কৃমি) দূর করা যায় ।
৪) হার্টের
স্বাস্থ্য উন্নতি করে
পেয়ারার
মধ্যে থাকে প্রচুর পটাশিয়াম (প্রায় ৪১৭ মিলি.গ্রাম) এবং ম্যাগনেশিয়াম (প্রায় ২২
মিলি.গ্রাম), যারা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ।
এছাড়াও পেয়ারার মধ্যে থাকা ফাইবার রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল(LDL) কমাতে সাহায্য করে ।
৫) ত্বক
ও চুলের যত্ন নিতে পারে
পেয়ারার মধ্যে থাকা ভিটামিন-সি এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং ত্বকের বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে । পেয়ারা পাতা বেটে মুখে লাগালে ব্রণ কমানো যায় । পেয়ারা পাতার রস চুলের গোড়া শক্ত করতে এবং খুসকি দূর করে ।
৬) ক্যান্সার
প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে
পেয়ারার মধ্যে থাকে লাইকোপেন এবং কোয়ারসেটিনের মতো উচ্চ শ্রেণীর অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, যারা ক্যান্সার সেল গঠনে বাধা প্রদান করে বলে জানা গেছে । বিশেষ করে পুরুষদের প্রস্টেট ক্যান্সার এবং মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে পেয়ারা অত্যন্ত কার্যকরী ।
৭) চোখের
স্বাস্থ্য ভালো রাখে
পেয়ারার মধ্যে খুব ভালো পরিমাণে ভিটামিন-এ থাকে (প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৬২৪ IU), যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই কার্যকরী । উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন-এ থাকায় এটি চোখের রেটিনা সুস্থ রাখতে সাহায্য করে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করতে পারে ।
৮) গর্ভবতী
মহিলাদের জন্য উপকারী
পেয়ারা গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করতে পারে, কারণ এটিতে খুব ভালো পরিমাণে ফোলিক অ্যাসিড থাকে ।
পেয়ারা খাওয়ার অপকারিতা কী ?
১) পেটে
গ্যাস বা ব্যথা : প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা খেলে এর মধ্যে থাকা উচ্চ ফাইবারের কারণে পেট
ফাঁপা, পেটে ব্যথা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে । বিশেষ করে যারা IBS (ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম)-য়ের সমস্যায়
ভুগছেন, তাদের জন্য পেয়ারা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে ।
২) ঠান্ডা
লাগার ঝুঁকি : পেয়ারা
প্রকৃতিতে ঠান্ডা (আয়ুর্বেদিক মতে), তাই সর্দি-কাশিতে ভুগলে পরিমিত খেতে হবে । একই
কারণে শীতকালে বেশি পেয়ারা খেলে কাশি বা সর্দি লাগতে পারে ।
৩) কাঁচা পেয়ারার ক্ষতিকর দিক : কাঁচা পেয়ারাতে পাকা পেয়ারার তুলনায় বেশি পরিমাণে ট্যানিন থাকে, যা পেটে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করতে পারে । উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন-সিয়ের সাথে ট্যানিন অ্যাসিডিটির সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে, তাই গ্যাস্ট্রিক আলসার থাকলে পেয়ারা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো ।
৪) ওষুধের
সাথে প্রতিক্রিয়া : কিছু রক্ত পাতলা করার শ্রেণীর ওষুধ (যেমন: ওয়ারফারিন) খেলে পেয়ারা
শরীরে ভিটামিন-কের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে । তাছাড়া
ডায়াবেটিসের ওষুধের সাথে পেয়ারা খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ অতিরিক্ত হারে কমিয়ে
দিতে পারে । তাই, এইসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করেই চলা উচিত ।
৫) পেস্টিসাইডের
ঝুঁকি : অতিরিক্ত
হারে ফলনের জন্য বর্তমানে পেয়ারা চাষে প্রচুর পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হচ্ছে । বিশেষত:
বাজারে বিক্রি হওয়া পেয়ারাতে পেস্টিসাইডের পরিমাণ খুব বেশি থাকতে পারে । সবসময়
ভালোভাবে ধুয়ে পেয়ারা খাবেন, নয়তো পেটের ইনফেকশন হতে পারে ।
পেয়ারা
বনাম আপেল : কে বেশি পুষ্টিকর?
বিষয় |
পেয়ারা |
আপেল |
ভিটামিন
সি |
১টি পেয়ারা=দৈনিক চাহিদার ২২৮% |
১টি আপেল=দৈনিক চাহিদার
১৪% |
ফাইবার |
৯ গ্রাম (প্রতি ১০০ গ্রামে) |
২.৪ গ্রাম (প্রতি ১০০
গ্রামে) |
ক্যালোরি |
৬৮ ক্যালোরি |
৫২ ক্যালোরি |
পটাশিয়াম |
৪১৭ মিগ্রা |
১০৭ মিগ্রা |
দাম
ও প্রাপ্যতা |
সস্তা (২০-৫০ টাকা/কেজি), সারা
বছর |
তুলনামূলক দামি
(২০০-৩০০ টাকা/কেজি), আমদানি নির্ভর |
ব্যবহার |
জুস, সালাদ,
আচার, জ্যাম,
চাটনি |
কাঁচা, জুস, পাই, স্মুদি |
স্থানীয়
চাষ |
উভয় বাংলাতেই ব্যাপক চাষ হয় |
স্থানীয় চাষ অত্যন্তই
কম |
পুর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ, উভয় বাংলার প্রেক্ষাপটে পেয়ারা জিতে যায় ! কারন এটি দামে সস্তা, পুষ্টিতে ভরপুর, আর স্থানীয়ভাবে চাষ হওয়ায় এটি সবার জন্য সহজলভ্য । আপেলের চেয়ে পেয়ারায় ভিটামিন সি, ফাইবার এবং পটাশিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি । এছাড়া, পেয়ারা দিয়ে তৈরি করা যায় নানা রকমের স্থানীয় খাবার—যেমন পেয়ারার আচার, জুস, জ্যাম বা কাসুন্দি ও অন্যান্য মশলার সাথে মিশিয়ে চাট ইত্যাদি ।
প্রায়শ:ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১)
পেয়ারা কখন খাওয়া ভালো ?
উত্তর):
সকালের ভারী জলখাবার খাওয়ার পর বা বিকেলে স্ন্যাক্স হিসেবে পেয়ারা খাওয়া ভালো । খালি পেটে পেয়ারা খাওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ পেয়ারার মধ্যে থাকা অ্যাসিডিক
প্রোপার্টি পেটে গ্যাস বা ব্যথা তৈরি করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীরা খাবার খাওয়ার ১
ঘণ্টা পর পেয়ারা খান—এটি রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য
করবে। রাতের বেলা পেয়ারা খেলে ঠান্ডা লাগার ঝুঁকি থাকে, তাই সন্ধ্যার পর এড়িয়ে চলুন।
২)
রোজ একটা করে পেয়ারা খেলে কী হয় ?
উত্তর):
পেয়ারার মধ্যে থাকা ভিটামিন-সি, আপনার দৈনিক ভিটামিন সি-এর চাহিদার ২২৮% পূরণ করবে, যা ত্বক, চুল ও ইমিউনিটির জন্য অপরিহার্য । তাছাড়া এর মধ্যে থাকা ফাইবার আপনার
হজমশক্তি বাড়াতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে । তবে দিনে ২টার বেশি পেয়ারা
খাওয়া ঠিক নয়, কারণ অতিরিক্ত ফাইবারের গ্রহণের ফলে ডায়রিয়া হতে পারে । প্রতিদিন
১টি পাকা পেয়ারা খাওয়ার অভ্যাস করাই সবচেয়ে ভালো !
৩)
খালি পেটে পেয়ারা খেলে কী সমস্যা হতে পারে ?
উত্তর):
খালি পেটে পেয়ারা (বিশেষত কাঁচা) খেলে পেটে ব্যথা, গ্যাস, অ্যাসিডিটির সৃষ্টি হতে পারে । পেয়ারার
মধ্যে থাকা ট্যানিন এবং সাইট্রিক অ্যাসিড পেটে জ্বালা-পোড়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে ।
যদি খালি পেটে খেতেই হয়, তবে অবশ্যই খাওয়ার আগে অন্তত: এক কাপ
জল খেয়ে নিন, তারপর পাকা পেয়ারা অল্প পরিমাণে খান ।
৪)
কোন পেয়ারার গুণ বেশি – কাঁচা
নাকি পাকা ?
উত্রর): গুণগত দিক থেকে সামান্য তারতম্যের জন্যে এবং আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পছন্দ করুন –
কাঁচা
পেয়ারা : কাচা
পেয়ারায় ভিটামিন সি বেশি (প্রতি ১০০ গ্রামে ২২৮ মিগ্রা) এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি
থাকে, তাই ডায়াবেটিসের জন্য ভালো হতে পারে ।
কাঁচা পেয়ারা স্যালাড বা চাটনিতে ব্যবহার করেও খাওয়া যেতে পারে ।
পাকা
পেয়ারা : পাকা
পেয়ারায় অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের পরিমাণ বেশি থাকে (বিশেষত: লাইকোপেন), তাই হজম করা সহজ এবং স্বাদেও
মিষ্টি । পাকা পেয়ারা জুস বা ডেজার্টে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
৫)
পেয়ারা পাতার উপকারিতা কী ?
উত্তর):
পেয়ারা শুধু ফল হিসাবে নয়, তার গাছের পাতাও বহু সুবিধা দিতে পারে । পেয়ারা পাতা চা
বানিয়ে খেলে ডায়রিয়া, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, বা ডেঙ্গু জ্বরে প্লেটলেট বাড়াতে
সাহায্য করে । গবেষণা অনুযায়ী, পেয়ারা পাতায় কোয়ারসেটিন নামক একটি অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি
উপাদান থাকে, যা অ্যালার্জি কমায় । এছাড়া, পেয়ারা পাতা পিষে ক্ষতস্থানে লাগালে ইনফেকশন সারতে সাহায্য করে এবং
ত্বকে লাগালে ত্বকের ব্রণ কমাতে বা জ্বালা-পোড়া কমাতে সাহায্য করে ।
৬) গর্ভবতী
মহিলারা কি পেয়ারা খেতে পারবেন ?
উত্তর):
পেয়ারার মধ্যে ভালো পরিমাণে ফোলিক অ্যাসিড থাকে, যা গর্ভস্থ শিশুর স্পাইনাল কর্ডের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
তাছাড়া, এর মধ্যে থাকা আয়রন
রক্তাল্পতা দূর করতে সাহায্য করে । তবে গর্ভাবস্থায় কাচা পেয়ারা এড়িয়ে যাওয়াই
ভালো, আর দিনে ১টার বেশি পেয়ারা খাওয়া উচিত নয় । তবে আপনার অন্তর্নিহিত বিশেষ
কারণজনিত অসুবিধা এড়াতে ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে একবার পরামর্শ করে নিন ।
সব
শেষে...
স্বাস্থ্য
উপকারিতা অনুযায়ী পেয়ারা শুধু একটি ফল নয়, এটি বাংলার স্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ । বাংলার সাধারণ মানুষের সাধ্য
অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ফল খাওয়ার বিলাসিতা পূরণ করতে পারে একমাত্র পেয়ারাই !
পরিমিত পরিমাণে পেয়ারা খান আর এর স্বাস্থ্যলাভ ওঠান আর সুস্থ থাকুন । যদি আপনার পেয়ারা গাছ বসানোর মতো জমি থাকে, তাহলে
পেয়ারা গাছ বসিয়ে পেস্টিসাইড মুক্ত পেয়ারার লাভ ওঠান । উপকারিতার দিক থেকে আমাদের
বাংলার এই ফলটি আপেলের থেকে কোন অংশেই কম নয়, বরং বেশ কিছু দিক থেকে সেরা ।
পোস্টটি শেয়ার করে সবাইকে জানান বাংলার আপেলের গুণাগুণ আর এই ফলের সুবিধা ওঠাতে
সাধারণ মানুষকে সাহায্য করুন ।
লেখাটি
পড়ে কি আপনার উপকারী বা কার্যকরী মনে হলো ? কমেন্টে জানান, আর
যদি অন্য কোন ফল নিয়ে জানতে চান তা লিখুন, আমরা অবশ্যই চেষ্টা করবো সেই ফলটি
সম্পর্কে জানাবার !
0 মন্তব্যসমূহ