হেঁচকি একটি অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা এবং যেকোন সমসয়ই যেকোন কারোর হতে পারে । এটি সাধারণত: ক্ষতিকারক নয়, তবে ক্রমাগত হেচকি বিরক্তিকর হতে পারে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য-সমস্যার ইঙ্গিত দেয় । এই ব্লগ পোস্টে আমরা হেঁচকি সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো, যেমন – হেঁচকি কি, কেন আপনার হেঁচকি ওঠে, ক্রমাগত হেঁচকি উঠতে থাকলে কি করতে হবে এবং হেঁচকি এড়ানোর কিছু উপায় ইত্যাদি ।
হেঁচকি কী?
যখন হেঁচকি ওঠে, তখন আমাদের ডায়াফ্রাম পেশী, যা আমাদের শ্বাস নিতে সাহায্য করে, সেটা অনিচ্ছাকৃতভাবে সঙ্কুচিত হয় । আর এই আকস্মিক সঙ্কোচনের ফলে আপনার ভোকাল কর্ডগুলি দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়, যা পরিচিত “হিঁক” করে শব্দ তৈরী হয় । সাধারণ ক্ষেত্রে হেঁচকি কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন অবধি স্থায়ী হতে পারে ।
কেন আমার বারবার হেঁচকি ওঠে?
সাধারণ ক্ষেত্রে হেঁচকি ওঠার বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে কিছু কারণ এখানে আলোচনা করা হলো –
১)
খুব দ্রুত খাওয়া বা অতিরিক্ত খাওয়া
খুব দ্রুত খাবার খাওয়া বা বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়ার কারণে, দ্রুত খাবার গেলার জন্য পেটে অতিরিক্ত বাতাস পেটে প্রবেশ করতে পারে, যা ডায়াফ্রামকে বিরক্ত করতে পারে, যার ফলে হেঁচকি উঠতে পারে ।
২)
কার্বনেটেড পানীয় পান করা
নরম পানীয় বা কার্বনেটেড পানীয় পান করার ফলে পেটে গ্যাস নির্গত করে, যা ডায়াফ্রামকে হঠাৎ প্রসারিত এবং সঙ্কুচিত করতে পারে । যার ফল হিসাবে হেঁচকি উঠতে পারে ।
৩)
মশলাদার বা গরম খাবার
অতিরিক্ত ঝাল, মশলাদার খাবার আমাদের পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুগুলিকে বিরক্ত করতে পারে, যার ফলে হেঁচকি উঠতে পারে । আবার খুব গরম খাবার আমাদের গলা বা ডায়াফ্রামের তাপমাত্রায় আকস্মিকভাবে পরিবর্তন আনতে পারে, যা হেঁচকির সৃষ্টি করতে পারে ।
৪)
তাপমাত্রায় হঠাৎ পরিবর্তন
হঠাৎ গরম খাবারের পরে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানীয় পান করা বা গরম পরিবেশ থেকে খুব ঠান্ডা পরিবেশে যাওয়ার ফলে তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন ডায়াফ্রামকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে হেঁচকির সৃষ্টি হতে পারে ।
৫)
মানসিক উদ্দীপক
কখনো কখনো অতিরিক্ত চাপ, উত্তেজনা বা অতিরিক্ত উদ্বেগ ডায়াফ্রামগুলিকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে তুলতে পারে, যার ফলে হেঁচকি উঠতে পারে ।
৬)
অ্যালকোহল সেবন
অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে পাকস্থলীর আস্তরণকে উদ্দীপিত করতে পারে, যার ফলে ডায়াফ্রামে খিঁচুনীর সৃষ্টি হতে পারে, যার ফল হিসাবে হেঁচকি উঠতে পারে ।
৭)
অতিরিক্ত বাতাস গিলে ফেলা
খেতে খেতে কথা বলার
জন্য, চুয়িং গাম চিবানোর জন্যে অথবা স্ট্র বা পাইপ দিয়ে পানীয় পান করার সময়
অতিরিক্ত বাতাস চলে যেতে পারে, যা হেঁচকির কারণ হয়ে উঠতে পারে ।
৮)
গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD)
অনেক সময় অ্যাসিড রিফ্লাক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির পাকস্থলীর অ্যাসিডগুলি ডায়াফ্রামকে বিরক্ত করতে পারে, যা ঘন ঘন হেঁচকির কারণ হতে পারে ।
৯) ওষুধের প্রতিক্রিয়া
স্টেরয়েড, পেনকিলার বা সেডাটিভের মতো বেশ কিছু ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবে হেঁচকির কারণ হতে পারে ।
১০)
অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা
বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে ক্রমাগত হেঁচকি স্নায়ুর ক্ষতি, স্ট্রোক বা কিডনীর সমস্যার মতো কোন সমস্যার পূর্ব লক্ষণ হতে পারে । তাই যদি কখনো প্রায় ৪৮ ঘন্টার মতো বেশি সময় ধরে থাকে, তাহলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত ।
হেঁচকি বন্ধ না হলে কী করবেন?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেঁচকি নিজে থেকেই চলে যায়, কিন্তু যদি তা অব্যাহত থেকে যায়, তাহলে নীচের সহজ এবং ঘরোয়া প্রতিকারগুলি চেষ্টা করতে পারেন –
১)
আপনার শ্বাস ধরে রাখুন
একটি গভীর শ্বাস নিয়ে যতো বেশিক্ষণ সম্ভব তা ধরে রাখুন । এর ফলে রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা অনেক সময় হেঁচকি বন্ধ করতে সাহায্য করে ।
২)
ধীরে ধীরে ঠান্ডা জল পান করুন
অনেক সময় খুব ঠান্ডা জলে চুমুক দিলে তা আমাদের ভ্যাগাস নামক স্নায়ুকে উদ্দীপিত করতে পারে, যা আমাদের ডায়াফ্রামকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে এবং হেঁচকি বন্ধ করতে পারে ।
৩)
এক চা চামচ চিনি গিলে ফেলুন
দানাদার চিনি খেলে তা গলা তথা গলার স্নায়ুগুলিকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং হেঁচকি বন্ধ করতে পারে ।
৪)
একটি কাগজের ব্যাগে শ্বাস নিন
একটি কাগজের ব্যাগে শ্বাস নিতে থাকলে তা রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করে তুলতে পারে, যার ফলে ডায়াফ্রাম শান্ত হয়ে হেঁচকি বন্ধ করতে সাহায্য করে ।
৫)
ঠান্ডা জল দিয়ে গার্গল করুন
ঠান্ডা জল দিয়ে গার্গল করতে থাকলে গলার স্নায়ুগুলিকে ধাক্কা দিয়ে উদ্দীপিত করে তোলে এবং হেঁচকি বন্ধ করতে সাহায্য করে ।
ডায়াফ্রামের উপর তৈরী হওয়া চাপ কমাতে ডায়াফ্রামে আলতো করে চাপ দিয়ে ম্যাসাজ করলে অথবা হাঁটুগুলিকে বুকের কাছে টেনে এনে কিছুক্ষণ বসলে হেঁচকি বন্ধ হতে পারে ।
৭)
লেবু বা ভিনেগার চুষুন
অল্প পরিমাণে লেবুর রস বা ভিনিগার খেয়ে নিতে পারেন । কারণ এদের টক স্বাদ আপনার স্নায়ুগুলিকে বিভ্রান্ত করে হেচকি দূর করতে সাহায্য করতে পারে ।
৮)
ভ্যালসালভা কৌশল চেষ্টা করুন
আঙুল দিয়ে নাক চিপে ধরে, মুখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ছাড়ার চেষ্টা করুন, যাতে ডায়াফ্রামের উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় । বহু ক্ষেত্রে এটি করলে হেঁচকি বন্ধ হয়ে যায় ।
৯)
আপনার ঘাড় ম্যাসাজ করুন
অনেক সময় ঘাড়ের কাছের ক্যারোটিড ধমনীতে আলতো করে ম্যাসাজ করলে ডায়াফ্রাম শিথিল হয়ে হেঁচকি বন্ধ হয়ে যায় ।
১০)
নিজেকে অন্যমনস্ক করুন
কখনো কখনো মনোযোগ ঘোরানোর ফলে অর্থাৎ অন্য কোন কার্যকলাপে মনোনিবেশ করার ফলে তা হেঁচকি বন্ধ করতে সাহায্য করে ।
কখন ডাক্তারের সাথে দেখা করবেন?
যদি কখনো আপনার হেঁচকি ৪৮ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত । কারণ ক্রমাগত হেঁচকি নিম্নলিখিত কারণগুলির একটি লক্ষণ হতে পারে –
- স্নায়ুর ক্ষতি বা জ্বালা
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল কোন সমস্যা
- স্নায়বিক কোন ব্যাধি
- কোন ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া
হেঁচকি প্রতিরোধের টিপস
যদি কখনো ঘন ঘন হেঁচকির সমস্যা দেখা দিতে থাকে, তাহলে আপনি এই সহজ প্রতিকারগুলি অনুসরণ করতে পারেন –
- অতিরিক্ত বাতাস গেলা কম করার জন্যে ধীরে ধীরে খাবার খান বা পানীয় পান করুন ।
- যথা সম্ভব অতিরিক্ত ঝাল, মশলাদার খাবার এবং কার্বনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলুন ।
- গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো কৌশলগুলি অনুসরণের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন ।
- অতিরিক্ত খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন এবং যথাসম্ভব নিজেকে হাইড্রেটেড রাখার চেষ্টা করুন ।
- অ্যালকোহল গ্রহণ সীমিত করুন বা বন্ধ করুন ।
প্রায়শ:ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১)
প্রতিবার খাওয়ার সময় কেন আমার হেঁচকি ওঠে?
উত্তর): খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া, অতিরিক্ত ঝাল-মশলাদার খাবার খাওয়া আমাদের ডায়াফ্রামে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে বা তাকে উদ্দীপিত করতে পারে, যার ফলে হেঁচকি উঠতে পারে । অল্প পরিমাণে খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন ।
২)
ঘন ঘন হেঁচকি কি কোনও অন্তর্নিহিত রোগের লক্ষণ?
উত্তর): মাঝে মধ্যে হেঁচকি ওঠা একটি স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু ঘন ঘন হেঁচকি ওঠা কখনো কখনো অ্যাসিড রিফ্লাক্স, স্নায়ুর জ্বালা এমনকি স্নায়বিক কোন রোগের ইঙ্গিত দিতে পারে । আর যদি হেঁচকি ওঠা অব্যাহত থাকে, তাহলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন ।
৩) কতক্ষণ হেঁচকি থাকলে ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত?
উত্তর): যদি কখনো আপনার হেঁচকি ওঠা ৪৮ ঘন্টা বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে তা আপনার কোন গুরুতর অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য-সমস্যার লক্ষণ হতে পারে । তাই সেসব ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত ।
৪) হেঁচকি কি প্রতিরোধ করা যেতে পারে?
উত্তর): খুব তাড়াতাড়ি খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত ঝাল-মশলাদার খাবার খাওয়া, কার্বনেটেড পানীয় পান করা এড়িয়ে যাওয়া এবং নিয়মিত ভাবে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো কৌশলগুলির অভ্যাসের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের দ্বারা হেঁচকির মতো ঘটনাকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে ।
৫) ঘরোয়া প্রতিকার কি সত্যিই হেঁচকির জন্য কাজ করে?
উত্তর): অতিরিক্ত ঠান্ডা জল পান করা, শ্বাস ধরে রাখা, দানাদার চিনি গিলে ফেলা বা লেবুর রস খাওয়া ইত্যাদি ঘরোয়া প্রতিকারগুলির (উপরে দেখুন) মাধ্যমে হেঁচকি বন্ধ করা যেতে পারে ।
৬) মানসিক চাপ কি হেঁচকির কারণ হতে পারে?
উত্তর): মানসিক চাপ, উত্তেজনা বা উদ্বেগের মতো মানসিক কারণগুলি ডায়াফ্রাম নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলিকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে তুলতে পারে, যার ফলে হেঁচকি হতে পারে । গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো শিথিলকরণ কৌশলগুলির অভ্যাস এইসব ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে ।
হেঁচকি সাধারণভাবে একটি অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা এবং সাধারণত: অস্থায়ী হয় । তবে ঘন ঘন হেঁচকি ওঠা একটি বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে । হেঁচকি ওঠার সাধারণ ট্রিগারগুলিকে বোঝার মাধ্যমে এবং সহজ ঘরোয়া প্রতিকারগুলিকে ব্যবহার করে, হেঁচকির সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতেই পারে । কিন্তু যদি এটি দীর্ঘ সময় ধরে হতে থাকে, তাহলে তা কোন অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য-সমস্যার ইঙ্গিত করতে পারে, সুতরাং সেইসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ।
0 মন্তব্যসমূহ