মহিলাদের শরীরের হরমোনাল ব্যালান্স থেকে শুরু করে পুরুষের প্রস্টেটের স্বাস্থ্য – পেঁপের উপকারিতা অপরিসীম । আসুন, আমরা জেনে নিই মহিলা ও পুরুষের শরীরে পেঁপে কী করে, উভয়ের ক্ষেত্রেই পেঁপে খাওয়ার কি লাভ, কিভাবে এবং কতোটা খাবেন ।
সারা বিশ্ব
জুড়েই পেঁপে একটি সুস্বাদু, রসালো ফল হিসাবে সমাদৃত । আর বাংলায় একটি কথা আছে –
“পাকা পেঁপে পেটের বন্ধু” । কিন্তু এই কথাটি কি শুধুই কথার কথা ? নাকি এর কোন
সারবত্তা আছে ? আসলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পেঁপের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা এখনো অনেকেই
অজ্ঞ, আর সেখানেই উঠে আসে বেশ কিছু প্রশ্ন – যেমন মহিলাদের জন্য পেঁপের
উপকারিতা কি, পুরুষদের স্বাস্থ্যে পেঁপের ভূমিকা কি হতে পারে,
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে লাভ পাওয়ার জন্য পেঁপে খাওয়ার সঠিক নিয়ম কি, মহিলাদের
গর্ভাবস্থায় কি পেঁপে খাওয়া উচিত অথবা পেঁপের বীজ কি বিষাক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আসুন, আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা এইরকম বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিই ।
চলুন, সবার
আগে পেঁপের পুষ্টিভান্ডার খুলে দেখে নেওয়া যাক, পেঁপে আমাদের কি কি পুষ্টি-উপাদান
সরবরাহ করতে পারে এবং পেঁপের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা যাতে যুক্তি সঙ্গত
মনে হতে পারে -
পেঁপের
পুষ্টি-প্রোফাইল (প্রতি ১০০ গ্রামে)
পুষ্টি-উপাদান |
পরিমাণ |
দৈনিক চাহিদার কতো % |
ভিটামিন সি |
৬২ মি.গ্রা |
৭৫% |
ফাইবার |
১.৮ গ্রাম |
৭% |
পটাশিয়াম |
১৮২ মি.গ্রা |
৫% |
বিটা-ক্যারোটিন |
২৭৪ মাইক্রোগ্রাম |
৩০% |
ক্যালোরি |
৪৩ |
২% |
সুত্র : USDA ফুডডাটা সেন্ট্রাল
মহিলাদের স্বাস্থ্যে পেঁপের ৫টি সুবিধা
১) পিরিয়ডসের ব্যথা কমায়
পেঁপের মধ্যে থাকা প্যাপাইন নামক এনজাইম
প্রস্টাগ্ল্যান্ডিন নামক হরমোনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং পেশীর স্প্যাজম
কমিয়ে স্বাভাবিক প্রবাহকে নিশ্চিত করতে পারে । যার ফলে পিরিয়ডের সময়কার ক্র্যাম্প
প্রায় ৪০% অবধি কমতে পারে (সূত্র-জার্নাল অফ উয়োমেন্স হেলথ, ২০২০) ।
প্রো-টিপস – পিরিয়ডসের ব্যথা কমানোর জন্যে পিরিয়ডসের তিন দিন আগে থেকে রোজ সকালে কাঁচা পেঁপে বা কাঁচা পেঁপের জুস বানিয়ে খেতে পারেন ।
২) গর্ভাবস্থায় আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে পারে
পেঁপের মধ্যে ভিটামিন সি এবং ফোলেট থাকে, যা মানুষের শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জন্য একটি জরুরী উপাদান । গর্ভবতী মহিলারা দিনে ১০০ গ্রাম পাকা পেঁপে (কাঁচা নয়) খেলে রক্তাল্পতার সম্ভাবনা ২৫% কমে এবং গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক হয় (সূত্র-ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ নিউট্রিশন)। তবে সাবধানতার জন্যে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস এড়িয়ে যেতে পারেন বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে খেতে পারেন ।
৩) মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
পেঁপের মধ্যে থাকে বিটা-ক্যারোটিন ও লাইকোপিন উপাদান । যা কাঁচা পেঁপেতে বেশি করে পাওয়া যায় । যারা ফ্রি-র্যাডিক্যালস দূর করে DNA-র ক্ষতি রোধ করতে পারে । প্রতি সপ্তাহে তিন বার করে কাঁচা পেঁপে খেলে মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি ১৮% অবধি কমে যেতে পারে, বিশেষ করে মেনোপজ পরবর্তী পর্যায়ে (সূত্র-ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্যান্সার)।
৪) ত্বকের উজ্জলতা বাড়াতে পারে
দুই (২) চামচ পাকা পেঁপে, এক (১) চামচ মূলতানী মাটি,
পাঁচ (৫) ফোঁটা পাতিলেবুর রস একসাথে মিশিয়ে মাস্ক তৈরী করে মুখে পনেরো (১৫) মিনিট
লাগিয়ে রাখুন । এর ফলে পেঁপের এনজাইম মৃত ত্বককে দূর করে, এর ভিটামিন এ ও ভিটামিন
সি কোলাজেন উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে এবং বলিরেখা কমায় । সপ্তাহে অন্তত: দু’বার
করে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে ।
৫) পি.সি.ও.এস (PCOS)-য়ের সমস্যা
কমায়
পি.সি.ও.এস (PCOS)-য়ে ভুগছেন
এইরকম মহিলাদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত পিরিয়ডস নিয়ন্ত্রণে এবং ওজন কমাতে পেঁপে প্রায়
১২% অবধি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে (সূত্র-জার্নাল অফ ফার্টিলিটি সায়েন্স)। এমনকি
পেঁপের মধ্যেকার ফাইবার উপাদান ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে শর্করার মাত্রা
স্থিতিশীল রাখতেও সাহায্য করে ।
পুরুষদের স্বাস্থ্যে পেঁপের ৫টি সুবিধা
১)
শুক্রাণুর মান উন্নত করে
পেঁপের মধ্যে থাকা ভিটামিন-ই এবং জিঙ্ক উপাদান পুরুষদের ক্ষেত্রে স্পার্মের গতিশীলতা বাড়ায় এবং স্পার্মের সংখ্যা প্রায় ৩৫% বাড়িয়ে তোলে । বিশেষ করে ৩০-৪৫ বছর বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে দৈনিক ২০০ গ্রাম পেঁপে খাওয়ার ফলে ফার্টিলিটি প্রায় ২০% বাড়তে দেখা গেছে (সূত্র-এশিয়ান জার্নাল অফ অ্যান্ড্রোলজি) ।
২)
প্রস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
পেপের মধ্যে থাকা লাইকোপিন নামক উপাদান প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের উপর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব ফেলে এবং প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের কোষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । বিশেষত: যারা লাল ধরনের মাংস খান, তাদের ক্ষেত্রে দৈনিক পেঁপে খাওয়ার ফলে প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ৩০% অবধি কমানো যেতে পারে (সূত্র-ইউরোলজি রিসার্চ)।
৩)
পেশী গঠনে সাহায্য করে
পেঁপের মধ্যে থাকা এনজাইম প্রোটিনের বিপাকে এবং পেশী পুনর্গঠনে সহায়তা করে, আর পেঁপের মধ্যে থাকা পটাশিয়াম পেশীর ক্র্যাম্প দূর করতে সাহায্য করে । প্রচন্ড পরিশ্রম করার পরে বা জিম করার পরে ১০০ গ্রাম পাকা পেঁপে, ১টি পাকা কলা, ৫০ মিলি-র মতো দুধ একসঙ্গে মিশিয়ে স্মুদি বানিয়ে খেতে পারেন ।
৪)
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়
পেঁপের মধ্যে থাকা উচ্চ ফাইবার কনটেন্ট প্রায় ১৫% অবধি কোলেস্টেরল কমাতে পারে এবং ধমনীর মধ্যে প্লাক জমার প্রবণতা রোধ করে । বিশেষ উচ্চ রক্তচাপযুক্ত পুরুষ রোগীদের ক্ষেত্রে দৈনিক ১৫০ গ্রাম পাকা পেঁপে খাওয়ার ফল হিসাবে হার্ট ডিজিজের ঝুকি প্রায় ৪০% অবধি কমে যেতে দেখা যায় (সূত্র-আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন)।
৫)
লিভার ডিটক্সিফিকেশনে সহায়তা করে
কাঁচা
পেঁপে বা আরো ভালো করে বললে কাঁচা পেঁপের বীজ লিভারে এনজাইমের উৎপাদন বাড়ায় এবং
লিভারে ফ্যাট জমাকে প্রতিরোধ করে । লিভারের ALT (Alanine Transaminase) এবং AST (Aspartate Transaminase)-র অনুপাত বজায়
রাখার ক্ষেত্রে পেঁপেকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে দেখা গেছে । সপ্তাহে ৩ দিন কাঁচা পেঁপের
বীজ ৫-৬টি চিবিয়ে খেলে লিভারের এনজাইমের মাত্রা ২০% নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে (সূত্র-জার্নাল
অফ হেপাটোলজি) ।
প্রায়শ:ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১) গর্ভাবস্থায় পেঁপে খাওয়া কি নিরাপদ ?
উত্তর) : গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ক্ষেত্রে পাকা পেঁপে নিরাপদ হলেও (ভিটামিন এ কম থাকে), কাচা পেপে এড়িয়ে
যাওয়াই ভালো । কারণ, এটির মধ্যে থাকা উপাদানগুলি ইউটেরাল কন্ট্রাকশনকে ট্রিগার
করতে পারে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে এটি বিপজ্জনক হতে পারে ।
২) পেঁপে কি ওজন কমায় ?
উত্তর) : যেহেতু পেঁপেতে তুলনামূলকভাবে ক্যালোরি কম (১০০ গ্রাম পাকা
পেপেতে মাত্র ৪৩ ক্যালোরি) ফাইবার বেশি থাকে, তাই এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে
পারে । পেঁপের মধ্যে থাকা উচ্চ ফাইবার কনটেন্ট মেটাবলিজম প্রায় ২০% বাড়িয়ে তোলে,
যা খিদে কমায় এবং শরীরের বাড়তি ক্যালোরি বার্ন করতে সাহায্য করে ।
৩) পেঁপে কি পুরুষের টেস্টোস্টেরন বাড়ায় ?
উত্তর) : পেঁপের মধ্যে থাকা ভিটামিন সি এবং জিঙ্ক (প্রতি ১০০ গ্রামে
০.১ মি.গ্রাম) অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে শুক্রাণুকে সুরক্ষা প্রদান করে এবং
টেস্টোস্টেরনের মাত্রা প্রায় ১২% বাড়াতে পারে । প্রতিদিন ২০০ গ্রাম মতো পেঁপের সাথে কুমড়োর বীজ খেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে
পারে ।
৪) পেঁপে খালি পেটে খাওয়া যাবে?
উত্তর) : খালি পেটে পাকা পেঁপে খাওয়া চলতে পারে, তবে অ্যাসিডিটি
থাকলে দুপুরে খাওয়ার পরে খেলে ভালো ফল পেতে পারেন । সকালে খালি পেটে পাকা পেঁপে
মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে হজমশক্তি বাড়ে এবং পেটের মেদ কমাতে সাহায্য করে । তবে খালি
পেটে কাঁচা পেপে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো ।
৫) ডায়াবেটিসে কি পেঁপে খাওয়া যেতে পারে ?
উত্তর) : যদি কোন ব্যক্তির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (৬০)-এর কম থাকে,
এইরকম ডায়াবেটিকরা ৫০-৭০ গ্রাম অবধি পাকা পেঁপে খেতে পারেন । কারণ পেঁপের মধ্যে
থাকা ফাইবার রক্তে শর্করার বাড়ার গতিকে ধীর করে দেয় এবং ইনসুলিনের স্পাইক প্রতিরোধ
করে । তবে, ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে খাওয়াই ভালো, কারণ আপনার অন্তর্নিহিত
অবস্থা তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন ।
৬) পেঁপের বীজ কি বিষাক্ত?
উত্তর) : পেপের বীজ বিষাক্ত না হলেও, এর মধ্যে ক্যারিকেইন নামক একটি উপাদান
থাকে, যা খুব শক্তিশালী এবং পরজীবী নাশক হিসাবে কাজ করে । সাধারণভাবে কিডনীর
রোগীরা এবং গর্ভবতী মহিলারা এটিকে এড়িয়ে যাওয়া্ই ভালো । বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহারের
জন্য কখনোই ১ চা চামচের বেশি না খাওয়াই ভালো । ব্যবহারের সুবিধার জন্য বীজকে শকিয়ে
গুড়ো করে স্যালাডে ছড়িয়ে নিতে পারেন ।
কথায়
আছে, “পেঁপে যতো পাকা বেশি, গুণ ততো বেশি” । কিন্তু পেঁপেকে শুধুমাত্র একটি ফল
হিসাবে আখ্যা না দিয়ে একটি প্রাকৃতিক সুপারমেডিসিন বলাই মনে হয় উচিত হবে । কারণ মহিলাদের
হরমোনাল ব্যালান্স থেকে শুরু করে পুরুষদের প্রস্টেটের সমস্যা ও হৃদরোগের ঝুকি
কমানো – এই হলুদ কমলা রঙে মেশানো ফলের গুণ যেন অফুরান । মহিলাদের বিভিন্ন
স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে শুরু করে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানো বা লিভার ডিটক্সিফিকেশনের
মতো বহুমুখী ব্যবহার পেঁপেকে করে তুলেছে সবার পছন্দের । প্রাচীন আয়ুর্বেদিক তত্ত্ব
হোক বা আধুনিক বিজ্ঞান – সবাই পেঁপের বহুমূখী উপকারিতায় গুণমুগ্ধ হয়েছে । তবে মনে
রাখবেন, কিডনীর সমস্যা আছে বা গর্ভবতী হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে পেঁপে খান ।
কারণ, আপনার বিশেষ ক্ষেত্রে পেঁপের শক্তিশালী উপাদানগুলির মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা
এড়িয়ে চলাই ভালো । এই সাশ্রয়ী ও সুস্বাদু ফলের সঠিক ব্যবহারের জাদু আপনার স্বাস্থ্যকে
দিতে পারে নতুন প্রাণ এবং সজীবতা — প্রমাণ করুন, "প্রকৃতি সবচেয়ে বড় ডাক্তার”!
পোস্টটি পড়ে ভালো লাগলে এবং কার্যকরী
মনে হলে অন্যদের শেয়ার করবেন এবং কমেন্ট করে আমাদের উৎসাহিত করবেন । পড়ার জন্য
ধন্যবাদ ।
0 মন্তব্যসমূহ