আয়রনের ঘাটতি দূর করার জন্য পালং শাক ও বিটরুটের জুসের গুণ । প্রকৃতিকে সঙ্গী করে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করার উপায় জানুন । সঙ্গে জানুন, আয়রনের দৈনিক চাহিদা, পালং শাক ও বিটরুট জুস বানানোর রেসিপি, খাওয়ার নিয়ম এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর ।
আপনি কি রক্তাল্পতা বা আয়রনের ঘাটতির সমস্যায় ভুগছেন ? ওষুধের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করুন । এই ব্লগ পোস্টে আমরা জানার চেষ্টা করবো পালং শাক ও বিটরুটের জুস কীভাবে আয়রন বাড়ায় এবং এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা । সঙ্গে জানবো পালং শাক ও বিটরুটের জুস বানানোর সহজ রেসিপি এবং পাঠকদের সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলোর বিস্তারিত উত্তর । পাশাপাশি চার্টের মাধ্যমে দেখে নেবো বিভিন্ন খাবারে আয়রনের পরিমাণ এবং আয়রনের দৈনিক চাহিদা ।
আয়রনের ঘাটতি : কেন হয়
এবং বেশি ঝুঁকি কাদের ?
আয়রন হলো আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের একটি মূল উপাদান । আর হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করার দায়িত্ব নেয় । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ৩০% মানুষ আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতায় ভোগেন, বিশেষত: মহিলারা, গর্ভবতী মায়েরা ও শিশুরা ।
আয়রনের ঘাটতির ঝুঁকির
কারণ সমূহ :
- মহিলাদের গর্ভাবস্থা এবং
স্তন্যপান করানোর জন্য
- ভারী পিরিয়ডসের জন্য
- ভেগান বা নিরামিষাশী
ডায়েটের কারণে
- কিছু ক্রনিক ডিজিজের জন্য (যেমন: IBD, সেলিয়াক ডিজিজ)
আয়রনের ঘাটতির লক্ষণজনিত চার্ট :
লক্ষণ |
বিস্তারিত |
ক্লান্তি |
সামান্য
পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে ওঠা |
ত্বকের
পরিবর্তন |
ত্বকের
বর্ণ ফ্যাকাশে বা হলুদ ভাব হয়ে ওঠা |
মাথাব্যথা |
ঘন
ঘন মাইগ্রেন জাতীয় মাথাব্যথা |
চুল
পড়া |
নির্দিষ্ট
কোন কারণ ছাড়াই প্রতিদিন প্রায় ১০০+ চুল পড়ে যাওয়া |
পালং শাক ও বিটরুট বনাম
অন্যান্যরা : কে কতো আয়রন সরবরাহ করে?
নীচের চার্টে বেশ কয়েকটি খাদ্য উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো, দেখুন প্রতি ১০০ গ্রামে কে কতো আয়রনের পরিমাণ সরবরাহ করতে পারে –
খাবার |
আয়রন (মিগ্রা/১০০
গ্রামে) |
পালং শাক |
২.৭ |
বিটরুট |
০.৮ |
কিশমিশ |
১.৯ |
৩.৩ |
|
৫.৪ |
|
১.৫ |
|
৮.৮ |
|
ডার্ক চকোলেট(৭০-৮৫%) |
১১.৯ |
৬.৫ |
বিঃদ্রঃ : পালং শাক আর বিটরুটের জুসের মধ্যে পালং শাকে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকলেও বিটরুটের মধ্যে থাকা নাইট্রেট ও ফোলেট উপাদান রক্তের স্বাস্থ্য উন্নত করে তোলে । তাছাড়া পালং শাকের ভিটামিন-সি আয়রনের শোষণে সাহায্য করে, যা বিটরুটের আয়রনকেও কার্যকর করে তোলে !
পালং শাক আর বিট রুটের জুস বানানোর সঠিক পদ্ধতি
উপকরণ (দুই জন ব্যক্তির
জন্য) :
- পালং শাক : পরিমাণে ১ কাপ মতো (তাজা পাতা)
- বিটরুট : মাঝারি মাপের ১টি
- গাজর : মাঝারি মাপের ১টি
- আদা : সতেজ আদা ১ ইঞ্চি মতো মাপের
- লেবু : মাঝারি মাপের (যেন ১ টেবিল চামচ রস হয়)
- পরিস্রুত জল : ১ কাপ মতো মাপের
প্রস্তুত প্রণালী :
- ধোয়া ও কাটা : পেস্টিসাইড দূর করার জন্য সতেজ পালং শাক ১০ মিনিট লবণ জলে ভিজিয়ে রাখুন । বিটরুট ও গাজর পাতলা করে কুচি করে কেটে নিন ।
- ব্লেন্ড করুন : সব উপকরণ ব্লেন্ডারের মধ্যে নিয়ে মসৃণ না হওয়া পর্যন্ত ব্লেন্ডার চালিয়ে যান ।
- ছাঁকুন : ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড হওয়া মিশ্রণটি তুলে একটি পরিষ্কার মসলিন কাপড় বা ছাকনিতে ছেঁকে নিন ।
- সার্ভ করুন : ছেঁকে নেওয়ার পরে মিশ্রণটিতে লেবুর রস মিশিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাপে করে বা গ্লাসে পরিবেশন করুন ।
টিপস :
- জুসটির স্বাদ বাড়ানোর জন্যে আপেল বা কমলার রস মিশিয়ে নিতে পারেন ।
- শিশুদের (১ বছরের উপরের বাচ্চাদের জন্য) দিতে চাইলে জুসের মধ্যে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে নিতে পারেন ।
এই জুস খাওয়ার সেরা
সময় ও পরিমাণ
অবস্থা |
পরিমাণ (প্রতিদিন) |
সময় |
সাধারণ আয়রন ঘাটতি |
১ গ্লাস (২০০ মিলি) |
সকালে ব্রেকফাস্টের আগে |
গর্ভাবস্থা |
১০০-১৫০ মিলি |
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী |
ডায়াবেটিস |
১০০ মিলি |
বিকেলে স্ন্যাক্সের আগে |
বিঃদ্রঃ : জুস খাওয়ার ১ ঘণ্টা আগে বা পরে চা/কফি (বিশেষত: দুধ মেশানো) এড়িয়ে চলুন, কারণ এদের মধ্যে থাকা ট্যানিন আয়রন শোষণে বাধা দেয় ।
দৈনিক আয়রন চাহিদা
পূরণে কে কতোটা খাবেন?
বয়স ও লিঙ্গ |
দৈনিক চাহিদা (মিগ্রা) |
পালং-বিটরুট জুস থেকে (%) |
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ |
৮ |
৪৩.৭% |
প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা |
১৮ |
১৯.৪% |
গর্ভবতী |
২৭ |
১২.৯% |
শিশু (৪-৮ বছর) |
১০ |
৩৫% |
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা
- বিটরুটের নাইট্রেট : বিটরুটে নাইট্রেট থাকার জন্য অতিরিক্ত সেবনের ফলে মাথাব্যথা বা বমিভাব সৃষ্টি হতে পারে ।
- পালং শাকের অক্সালেট : পালং শাকে অক্সালেট
থাকে, তাই কিডনি স্টোনের ইতিহাস থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পান করুন বা পান
করলেও খুবই সীমিত পরিমাণে পান করুন ।
- ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া : থাইরয়েড বা ব্লাড প্রেশার জনিত ওষুধ খেলে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে পান করুন, কারণ এই ধরনের ওষুধগুলির সাথে এই জুসকে প্রতিক্রিয়া করতে দেখা যায় ।
প্রায়শ:ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১)
জুসটি কতদিন খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ে?
উত্তর): আমাদের
শরীরে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন একটি ধীর প্রক্রিয়া । সাধারণভাবে
নিয়মিত ৪-৬ সপ্তাহ এই জুস খেলে রক্ত পরীক্ষায় পরিবর্তন দেখা যায়। গড়ে, একজন
প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার দৈনিক ১৮ মিগ্রা আয়রন প্রয়োজন, আর এই জুসের এক গ্লাসে
প্রায় ৩.৫ মিগ্রা আয়রন থাকে, তাই ডায়েটে অন্যান্য আয়রনসমৃদ্ধ খাবার (ডাল, বীজ)
যোগ করা জরুরি । আর মনে রাখতে হবে ভিটামিন-সি আয়রনের শোষণ ২-৩ গুণ বাড়াতে পারে ।
তাই ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরী ।
২) পালং
শাকের অক্সালেট কি কিডনির পাথরের কারণ হয়?
উত্তর): পালং শাকে
সাধারণভাবে অক্সালিক অ্যাসিড থাকে, যা কিডনিতে
পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়াতে পারে । যদি আপনার কিডনির সমস্যা থাকে, পালং
শাক সেদ্ধ করে তার জলটি ফেলে দিয়ে ব্যবহার করতে পারেন, এতে অক্সলেটের পরিমাণ
প্রায় ৪০% কমে যায় । তবে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে পান করাই ভালো ।
৩)
গর্ভাবস্থায় এই জুস খাওয়া কি নিরাপদ?
উত্তর): গর্ভাবস্থায়
মহিলাদের আয়রনের চাহিদা বেড়ে দৈনিক প্রায় ২৭ মিগ্রা হয়। এই জুস আয়রন ও ফোলেট
সরবরাহ করে, যা
ভ্রূণের বিকাশে সাহায্য করতে পারে । তবে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে তবেই
পান করুন, কারণ আপনার অন্তর্নিহিত অবস্থা নিরীক্ষণ করে তিনিই সেরা পরামর্শ দিতে
পারেন ।
৪) এই জুস
খাওয়ার পর প্রস্রাব লাল হওয়া স্বাভাবিক কি?
উত্তর): যেহেতু
বিটরুটে
বিটাসায়ানিন নামক একধরনের পিগমেন্ট থাকে, তাই এটি গ্রহণের ফলে প্রস্রাব বা মল
লালচে হতে পারে । তবে এটি সম্পূর্ণ নিরীহ প্রতিক্রিয়া এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক
হয়ে যায় । তবে যদি রক্তপাতের সন্দেহ হয়, তাহলে
ডাক্তার
দেখান ।
৫)
জুসের পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে কীভাবে সংরক্ষণ করবেন?
উত্তর): জুস বানানোর পর
খেয়ে ফেলাই সবচেয়ে ভালো, কারণ অক্সিজেন ও আলোর সংস্পর্শে এর মধ্যেকার ভিটামিন-সি
নষ্ট হয়ে যেতে পারে । তবে যদি সংরক্ষণ করতেই হয়, এয়ারটাইট
কন্টেনারের মধ্যে রেখে ফ্রিজে রাখুন এবং সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে খেয়ে ফেলুন ।
৬)
আয়রন শোষণ বাড়াতে এর সঙ্গে আর কী কী খাবেন?
উত্তর) : আয়রন শোষণ
বাড়াতে এই জুসের সঙ্গে নীচের খাবারগুলি খেতে পারেন -
- ভিটামিন সি : লেবু, পেয়ারা, ক্যাপসিকাম
- প্রোবায়োটিক : দই, ফার্মেন্টেড খাবার
- মাংস/মাছ : হিম আয়রন (প্ল্যান্ট-বেসড আয়রনের চেয়ে ৩ গুণ ভালো শোষিত হয়)
সব শেষে .......
পালং শাক ও বিটরুটের জুস
শুধু আয়রনই নয়, সার্বিক
স্বাস্থ্যের জন্যও পুষ্টি-উপাদান সরবরাহ করার জন্য একটি পাওয়ারহাউস বলা যেতে পারে
। সঠিকভাবে বানানোর সাথে এটি নিয়মিত পান করুন, সঠিক
ডায়েট মেনে চলুন এবং রক্ত পরীক্ষা করান প্রতি ৬ মাসে অন্তত: একবার । মনে রাখবেন, প্রাকৃতিক
সমাধান সময়সাপেক্ষ, কিন্তু
খারাপ প্রতিক্রিয়া করা ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদী ফল দেয় !
শেয়ার করুন ও জানান : এই
পোস্টটি আপনার ভালো লাগলে বা উপকারী মনে বা আপনার ক্ষেত্রে সাহায্য করলে সোশ্যাল
মিডিয়ায় শেয়ার করে অন্যদের আয়রন ঘাটতি সম্পর্কে সচেতন করুন।
অতিরিক্ত বিশ্বস্ত সোর্স এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন :
১) WHO-এর ডায়েটারি গাইডলাইন :
0 মন্তব্যসমূহ