গরমে হিট স্ট্রোক এড়াতে কী কী খাবার খাবেন? জেনে নিন, সহজ ভাষায় হিট স্ট্রোকের লক্ষণ ও প্রতিকার, কিভাবে প্রাকৃতিক
উপায়ে হিট স্ট্রোক এড়ানো যাবে তার বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ টিপস, ডায়েট প্ল্যান এবং সেই সম্পর্কিত কিছু জরুরী প্রশ্নের উত্তর ।
গরমে হিট স্ট্রোক : কারণ, প্রভাব ও প্রতিরোধের যুক্তি
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় । যখন বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা ৪০°C ছড়িয়ে যাব, তখন শরীরের ঘাম বের হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় । ফলে শরীরের ভিতরে জমা তাপ বাড়তে থাকে, ফলে রক্ত গাঢ় হয়ে যায় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আকস্মিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয় । শরীরের এই অবস্থাকেই হিট স্ট্রোক বলে । শুধু জল পান করেই এই সমস্যার প্রতিরোধ করা যায়
না, প্রয়োজন প্রচুর ইলেকট্রোলাইটস (লবণ, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম) এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া । আমাদের পোস্টে বর্ণিত নীচের খাবারগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপায়ে শরীরকে শীতল রাখতে পারে এবং হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে ।
হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে ১২টি খাবার
১) তরমুজ
(Watermelon)
তরমুজে প্রায় ৯২% জল এবং ৮% ফাইবার ও প্রাকৃতিক শর্করা থাকে । এটি শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখার পাশাপাশি লাইকোপিন নামক অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সরবরাহ করে, যা ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করতে পারে । গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত তরমুজ খেলে রক্তনালীর কার্যকারিতা বাড়ে, যা শরীরের তাপ প্রাকৃতিকভাবে কমাতে সাহায্য করে।
২) ডাবের
জল (Coconut Water)
ডাবের জলে থাকে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, এবং ম্যাগনেশিয়াম—যা ঘামের মাধ্যমে হারানো মিনারেলস পূরণ করতে পারে । তাছাড়াও এটি রক্তের pH ব্যালান্স ঠিক রাখতে এবং কিডনীর কাজে সহায়তা করে । ডাবের জলে থাকা অস্মোটিক উপাদান শরীরে জলের শোষণ বাড়ায়, যা ORS-এর বিকল্প হিসেবে কাজ করে ।
৩) দই
বা ঘোল
(Curd/Buttermilk)
দইয়ের মধ্যে থাকা প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলি পেটের গরম ভাব কমাতে এবং হজম করতে সাহায্য করে । ঘোল তৈরি করার সময় সামান্য জিরা যোগ করে আয়রন শোষণ বাড়ানো যেতে পারে, যা আমাদের শরীরের সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণেও সহায়তা করে । এটি শরীরের মেটাবলিক রেট কমিয়ে তাপ উৎপাদন হ্রাস করে ।
৪) পুদিনা
পাতা (Mint)
পুদিনা পাতায় প্রাকৃতিক মেনথল থাকে, যা স্নায়ুকে শীতল করার সংকেত পাঠায় । এটি রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে ঘামের মাধ্যমে তাপ বের করতেও সাহায্য করে । পুদিনার অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ গলাব্যথা এবং সানবার্ন কমাতেও কার্যকরী ভূমিকা নেয় ।
৫) শসা
(Cucumber)
শসার মধ্যে থাকা সিলিকা উপাদান ত্বক ও চুলের জন্য খুবই উপকারী । তাছাড়া এটি শরীরের ভিতরের জ্বালাপোড়া কমায় এবং কিডনীকে টক্সিন মুক্ত করতে সাহায্য করে । প্রতিদিন ১টি করে শসা খেলে প্রায় ১ গ্লাস জলের সমান হাইড্রেশন পাওয়া
যায় ।
৬) লেবুর
শরবত (Lemonade)
লেবুর মধ্যে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড লিভারকে ডিটক্সিফাই করতে এবং হজম করতে সাহায্য করে । এর মধ্যে থাকা ভিটামিন-সি ইমিউনিটি ক্ষমতা বাড়ায়, যা গরমে ঘন ঘন ইনফেকশনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে । এর সঙ্গে লবণ ও চিনি যোগ করে গ্রহণ করলে এটি একটি প্রাকৃতিক ORS-এর মতো কাজ করে ।
৭) পেঁয়াজ
(Onion)
পেঁয়াজের মধ্যে থাকা কুয়ারসেটিন একটি শক্তিশালী অ্যান্টিহিস্টামিন, যা সানস্ট্রোকের কারণে হওয়া অ্যালার্জি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে । শতাব্দী প্রাচীন গ্রামীন চিকিৎসা
পদ্ধতিতে বর্ণিত আছে যে, মাথার তালুতে পেঁয়াজের রস লাগালে শরীরের তাপ কমানো যায় ।
৮) আমড়ার
শরবত (Hog Plum Drink)
আমড়ার মধ্যে রয়েছে টারটারিক অ্যাসিড এবং পলিফেনলস, যা শরীরের ভিতরের জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে । এটি একটি প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, যা গরমে একটি সাধারণ সমস্যা ।
৯) সবুজ
শাকসবজি (Green Vegetables)
পালং শাক, লাউ, চালকুমড়া ইত্যাদিতে প্রচুর ফোলেট এবং আয়রন থাকে, যা রক্তাল্পতা দূর করতে সাহায্য করে । তাছাড়া এগুলোর উচ্চ জলীয় অংশ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ফাইবার পেট ঠান্ডা রাখে ।
১০) ঠান্ডা দুধ
(Cold Milk)
দুধের মধ্যে থাকা ট্রিপটোফ্যান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড স্ট্রেস হরমোন কমাতে সাহায্য করে । ঠাণ্ডা দুধ পান করলে গ্যাস্ট্রিকের জ্বালাপোড়া কমে এবং পেশির খিঁচুনীও দূর হয় ।
১১) তালের শাঁস
(Palm Fruit)
কাঁচা তালের শাঁসে গ্লুকোজ,ফ্রুক্টোজ এবং পটাশিয়াম থাকে, যা তাৎক্ষণিক এনার্জি সরবরাহ করতে পারে । এটি ডিহাইড্রেশনের কারণে হওয়া মাথা ঘোরা কমাতেও সাহায্য করে ।
১২) ভেষজ চা
(Herbal Tea)
তুলসী বা পুদিনার চায়ে থাকা ইউজিনল এবং মেনথল শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে ভূমিকা নেয় । ক্যামোমাইল চা নার্ভ রিলাক্স করতে সাহায্য করে, যা গরমের অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে ।
হিট স্ট্রোক
এড়াতে বাড়তি
সতর্কতা:
- ৩-৪ লিটার জল পান করুন : শরীরের প্রতিটি কোষের কাজের জন্য জলের ভূমিকা অপরিহার্য । জলের অভাবে রক্ত ঘন হয়ে গেলে হার্টকে অক্সিজেন পাম্প করতে বেশি পরিশ্রম করতে হয়, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে ।
- সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রোদ এড়িয়ে চলুন : এই সময়ে UV রশ্মির তীব্রতা সর্বোচ্চ থাকে, যা ত্বক ও শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে ।
- সুতির কাপড় পরুন : সুতির কাপড়ে সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে, ফলে ঘাম দ্রুত শুকায় এবং শরীর ঠান্ডা থাকে ।
প্রায়শ:ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১) হিট
স্ট্রোকের প্রাথমিক
লক্ষণগুলি কী
কী?
উত্তর): হিট স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- তীব্র মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা
- পেশিতে খিঁচুনী বা দুর্বলতা
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
- ত্বক শুষ্ক, লাল, এবং গরম অনুভূত হওয়া
- নাড়ির গতি দ্রুত কিন্তু দুর্বল বোধ করা
এই লক্ষণ দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দ্রুত ঠান্ডা স্থানে নিয়ে যান এবং ধীরে ধীরে জল বা ORS বা লেবুর শরবত পান করান ।
২) গরমে
সবচেয়ে ভালো
ড্রিংক কী?
উত্তর) : গরমের সময় ডাবের জল এবং লেবু-লবণ-চিনির শরবত সেরা পানীয় । ডাবের জলে প্রচুর প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইটস থাকে, যা রক্তের ঘনত্ব কমায় । লেবুর শরবত লিভার ডিটক্স করে এবং এনার্জি দেয় । ORS স্যালাইনও কার্যকর, তবে চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহার করলে মিনারেলস বেশি শোষিত হতে পারে ।
৩) হিট স্ট্রোক হলে কী খাওয়া উচিত নয়?
উত্তর): হিট স্ট্র্রোক হলে এড়িয়ে চলুন—
- কফি বা চা : ক্যাফেইন প্রস্রাবের মাধ্যমে জল বের করে দেয়, যা ডিহাইড্রেশন বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
- অ্যালকোহল : এটি রক্তনালী প্রসারিত করে শরীরের তাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- ফাস্ট ফুড : অতিরিক্ত তেল-মসলা হজমের সমস্যা তৈরী করে এবং শরীরে তাপ উৎপন্ন করে ।
৪) হিট
স্ট্রোক থেকে
সেরে উঠতে
কতদিন লাগে?
উত্তর): সাধারণ ক্ষেত্রে ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উন্নতি হয় যদি পর্যাপ্ত জল পান করা যায় এবং
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া যায় । তবে গুরুতর ক্ষেত্রে (যেমন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শরীরের তাপমাত্রা ১০৪°F ছাড়ানো) হাসপাতালে ভর্তি হয়ে IV ফ্লুইড নেওয়া প্রয়োজন এবং সেক্ষেত্রে পূর্ণ সুস্থ হতে ১ সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে ।
৫) ঘরোয়া
উপায়ে হিট
স্ট্রোকের চিকিৎসা
কী?
উত্তর): হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে জরুরী ঘরোয়া পদক্ষেপ গুলি হলো —
- রোগীকে ছায়ায় বা এসি
রুমে নিয়ে যান ।
- কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দিন, বিশেষ করে
কপাল, বগল, ও
গোড়ালিতে বরফ দিতে পারেন ।
- পা
উঁচু করে শুইয়ে রাখুন যাতে রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে ।
- ধীরে ধীরে ডাবের জল বা লবণ-চিনির শরবত বা ORS পান করান ।
যদি ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্যক্তি সাড়া না দেন, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান ।
৬) শিশু
ও বয়স্কদের
হিট স্ট্রোকের
ঝুঁকি বেশি
কেন?
উত্তর): শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের ঝুকি বেশি তার কারণগুলি
হলো -
- শিশুদের ক্ষেত্রে : শিশুদের শরীরের ভর অনুপাতে ত্বকের ক্ষেত্রফল বেশি, তাই তারা দ্রুত তাপ শোষণ করে । তাছাড়া তাদের ঘাম গ্রন্থিগুলিও পুরোপুরি বিকশিত হয় না ।
- বয়স্কদের ক্ষেত্রে : ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের মতো রোগ এবং কিছু ওষুধ (যেমন ডাই-ইউরেটিক্স) শরীরের স্বাভাবিক তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ।
সব শেষে .....
গ্রীষ্মের তপ্ত রোদ শুধু অস্বস্তিদায়কই নয়, জীবনঘাতীও হতে পারে । কিন্তু প্রকৃতি আমাদের প্রতিটি সমস্যার সাথে সমাধানও দিয়ে রেখেছে । তরমুজ থেকে ডাবের জল, পুদিনা থেকে শসা—প্রতিটি খাবারই যেন প্রকৃতির ডাক্তার । শুধু প্রয়োজন সচেতনভাবে এগুলোকে নিজেদের ডায়েটে যুক্ত করা । আর সেখানেই শেষ নয়, আপনার জানা তথ্যগুলো আশেপাশের মানুষদের সাথে শেয়ার করুন, কারণ একটি শেয়ার হয়তো কারও জীবন বাঁচাতে পারে । গরমে সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং প্রকৃতির উপহারকে কাজে লাগান ।
0 মন্তব্যসমূহ