ডি-টক্সিফিকেশনে
সহায়তা থেকে শুরু করে প্রদাহ কমানো এবং ফ্যাটি লিভারের প্রতিরোধ করার মতো আমাদের লিভার সুস্থ রাখতে হলুদের ৭টি
অলৌকিক উপকারিতা প্রদান করার
ক্ষমতা রয়েছে । আসুন, এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা লিভার সুস্থ রাখতে হলুদের সেই
৭টি অলৌকিক উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিই ।
লিভারের উপরে
আমাদের সামগ্রিক সুস্থতা অনেকখানি নির্ভর করে । আমরা যে খাবার খাই তার মধ্যেকার
পুষ্টি-উপাদান গুলোকে ভেঙে ফেলা, গ্লুকোজকে পরবর্তী সমসয়ে ব্যবহারের জন্য
গ্লাইকোজেনে রূপান্ত করা, শরীরে প্রবেশ করা ক্ষতিকারক পদার্থকে বের করে দেওয়া,
ওষুধের ক্ষতিকারক অংশ এবং অ্যালকোহলকে প্রক্রিয়াজাত করে শরীর থেকে বের করে
বিষমুক্ত করা, রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যালবুমিন নামক প্রোটিন
সংশ্লেষ করা, ভিটামিন এ-ডি-ই-কে-বি১২ এবং আয়রন ও কপারের মতো খনিজের শোষণে সহায়তা করা ইত্যাদি
গুরুত্বপূর্ণ কাজে লিভার অংশগ্রহণ করে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । তাই,
লিভারের সুস্থতা এবং কার্যকারিতা বজায় রাখা আমাদের সুস্থতার জন্যে অত্যন্ত
প্রয়োজনীয় ।
হলুদের ৭টি অলৌকিক উপকারিতা
হলুদ তার সোনালি আভা রঙ ও তার অনবদ্য সুগন্ধের জন্য
বিশ্ববিখ্যাত । কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি মশলা নয়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও বিশেষত:
লিভারের জন্য হলুদের উপকারিতা অতুলনীয় । হলুদের মধ্যে থাকা প্রধান সক্রিয় উপাদান
হলো কারকিউমিন, যার অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট জাতীয় প্রভাব লিভারের ক্ষেত্রে অপরিসীম
অবদান রয়েছে । যারা লিভার সুস্থ রাখতে চান তাদের জণ্য হলুদ কিভাবে লিভারের জন্য
প্রতিরক্ষামূলক ও পুনরুদ্ধারকারী হিসাবে কাজ করে জানার সাথে সাথে আমরা লিভার সুস্থ রাখতে হলুদের ৭টি
অলৌকিক উপকারিতা গুলি এখানে আলোচনা করবো ।
১) হলুদের প্রদাহ-বিরোধী প্রভাব
হেপাটাইটিস, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এবং সিরোসিসের মতো রোগগুলির
প্রধান কারণ হলো প্রদাহ । শরীরে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের সরবরাহ ঠিক থাকলে প্রদাহ
এড়ানো যেতে পারে । হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন একটি উচ্চ শ্রেণীর
অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, যা প্রদাহকে বাধা দেয় । যার ফলে লিভারের উপর চাপ কমাতে
সাহায্য করে এবং লিভারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলে দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুকি কমায় ।
২) হলুদের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট প্রভাব
শরীরে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের অভাব ঘটলে ফ্রি-র্যাডিক্যালস
এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের প্রভাব বেড়ে যায়, যার ফলে লিভারের কোষের ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন একটি শক্তিশালী
অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট হিসাবে কাজ করে । এটির প্রভাবে ফ্রি-র্যাডিক্যালসগুলি
নিরপেক্ষ হয়ে যায় এবং কোষের মধ্যেকার অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমে যায় । যার ফলে লিভার
সুস্থভাবে তার কোষগুলির মেরামতি করে নেওয়া এবং কোষের পুনর্জন্ম ঘটানোর মতো
গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে নিতে পারে ।
৩) ডিটক্সিফিকেশন করানোর ক্ষমতা
হলুদ লিভারের এনজাইম নি:সরণের প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে এবং
পিত্ত উৎপাদনে সহায়তা করে শরীরে প্রবেশকারী বিষাক্ত পদার্থগুলির বিপাক প্রক্রিয়াকে
সহজতর করে তোলে । হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন লিভারের ডি-টক্সিফিকেশন প্রক্রিয়াকে
সমর্থন করে শরীর থেকে বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থগুলির অপসারণে সহায়তা করে এবং
সামগ্রিক সুস্থতার জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখে ।
৪) লিভারের কোষের পুনর্জন্মে সাহায্য করে
লিভার নিজেই তার ক্ষতিগ্রস্ত কোষের মেরামতি করতে পারে এবং
নিজের কোষের পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে । কিন্তু এই কাজটি ঘটানোর জন্যে
অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদান সরবরাহ অত্যন্ত আবশ্যক । হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন
একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট হিসাবে কাজ করে । এরা লিভারের কোষের মধ্যেকার সিগন্যালিং প্রক্রিয়াকে
সক্রিয় করে তুলে লিভারকে নিজের কোষগুলিকে মেরামতি করতে এবং কোষের পুনরুজ্জীবন
ঘটাতে উদ্দীপিত করে ।
৫) হলুদ লিভারে চর্বি জমা কমায়
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে বিশেষত: খারাপ খাদ্য গ্রহণ ও
খারাপ সময়ে খাদ্য গ্রহণের কারণে লিভারে অনাবশ্যক চর্বি জমা হতে থাকে, যা সেই
ব্যক্তিকে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) এর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে । হলুদের মধ্যে থাকা শক্তিশালী উপাদান কারকিউমিন
লিপিড বিপাকের হার বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত লিভার ফ্যাট কমাতে সহায়তা করে এবং
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করতে পারে ।
৬) লিভার ফাইব্রোসিস থেকে রক্ষা করে
লিভার কোষের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি লিভার ফাইব্রোসিসের দিকে
নিয়ে যেতে পারে,
যা সিরোসিসের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। হলুদের প্রদাহ-বিরোধী
এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাগুণ লিভারে হেপাটিক স্টেলেট কোষের সক্রিয়তা রোধ করতে
সাহায্য করে,
টিস্যুর দাগ এবং ফাইব্রোসিস হ্রাস করে, যার ফলে লিভারের কার্যকারিতা সংরক্ষণ করা হয়।
৭) অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে সমর্থন করে
লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য একটি সুস্থ অন্ত্র অত্যাবশ্যক।
হলুদ প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং একটি সুষম অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম তৈরিতে অবদান
রাখে, যার ফলে অন্ত্রের কার্যকারিতা সমর্থন করে। এইভাবে, হলুদ অন্ত্র-লিভার অক্ষ বজায় রাখতে সাহায্য করে, লিভারে সিস্টেমিক প্রদাহ কমায় এবং অঙ্গ থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ দূরে
স্থানান্তরে সহায়তা করে ।
দৈনিক ডায়েটে কিভাবে হলুদ যোগ করা যায়
১) গোল্ডেন মিল্ক : শরীরের বাড়তি কারকিউমিন পাওয়ার জন্য এবং
সেটি শোষণের সুবিধার জন্য দুধের সঙ্গে হলুদ আর এক চিমটি কালো মরিচ যোগ করে মিশিয়ে
পান করতে পারেন ।
২) তরকারি এবং স্ট্যুজ : বাড়িতে যেকোন তরকারি বা স্ট্যুজ বানানোর
সময়ে সবসময় স্বাদ এবং স্বাস্থ্য-উপকারিতা পাওয়ার জন্য হলুদ যোগ করে রান্না করুন ।
৩) স্মুদিতে যোগ করুন : যখনই আম, আনারসের মতো ফলের অথবা প্রোটিন শেক
বানাবেন, তার সঙ্গে অল্প হলুদ যোগ করে নিতে পারেন ।
৪) স্যুপ বানতে ব্যবহার করুন : যখনই কোন স্যুপ বা ঝোল বানাবেন, স্বাদ-বৃদ্ধির
জন্য এবং স্বাস্থ্য-উপাকারিতা পাওয়ার জন্য হলুদ মিশিয়ে রান্না করবেন ।
৫) স্যালাডে ব্যবহার করুন : যখনই কোন স্যালাড বানাবেন, স্যালাডের সঙ্গে
অল্প জলপাই তেল, লেবুর রস এবং হলুদ যোগ করে বাড়তি স্বাদ এবং স্বাস্থ্য-গুণ বাড়িয়ে
নিতে ভুলবেন না ।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ’s)
১) হলুদ কি লিভারের রোগ নিরাময় করতে পারে?
উত্তর) : যদিও শুধুমাত্র হলুদ ব্যবহার করে আপনি লিভারের রোগ
নিরাময় করে নিতে পারবেন না । কিন্তু এটাও সত্যি লিভারের বেশিরভাগ সমস্যা জীবনযাত্রার
কারণে সৃষ্ট, তাই এর অসাধারণ অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদান কারকিউমিন এই
সমস্যাগুলির চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে । কারণ এটি লিভারের মধ্যেকার
প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় ।
২) আমার প্রতিদিন কতটা হলুদ খাওয়া উচিত?
উত্তর) : যদিও হলুদ বা কারকিউমিনের কোন সার্বজনীন ডোজ নেই, তবুও বিভিন্ন অন্বেষণের পরে দেখা গেছে যে, সাধারণ স্বাস্থ্য-সুবিধা পাওয়ার জন্যে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ মিলিগ্রাম আদর্শ হতে পারে । তবে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে এটির মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে । তাই কোন বিশেষ অবস্থার জন্য বা কোন বিশেষ স্বাস্থ্য-লক্ষ্য পাওয়ার জন্য আপনার নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং লক্ষ্যের সাথে মানানসই একটি ডোজের জন্য কোন ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ।
৩) হলুদ কি সবার জন্য নিরাপদ?
উত্তর) : সাধারণভাবে একটি সাধারণ মাত্রায় হলুদ গ্রহণ নিরাপদ হিসাবে স্বীকৃত হয় । কিন্তু যেসব ব্যক্তি পিত্তথলির সমস্যার জন্য, কিডনীতে পাথর কমানোর জন্য বা রক্ত পাতলা রাখার জন্য ওষুধ সেবন করছেন তাদের প্রতিকূল প্রভাব বা জটিলতা এড়ানোর জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং সবসময় অতিরিক্ত পরিমাণে হলুদ বা কারকিউমিন গ্রহণের আগে কোন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত ।
৪) হলুদ কি ফ্যাটি লিভার রোগ
প্রতিরোধ করতে পারে?
উত্তর) :
শুধুমাত্র হলুদ প্রয়োগ করে ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধ করা যায় না । কিন্তু হলুদের
মধ্যেকার সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন লিভারের প্রদাহ কমিয়ে এবং লিভারে জমা চর্বি
বিপাকে সহায়তা করে । আর হলুদের সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত
ব্যয়াম করা, অ্যালকোহল গ্রহণ এড়ানো ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি সামগ্রিক পদ্ধতির
অনুশীলনের মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ডিজিজের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে ।
৫) হলুদ কি ওষুধের সাথে
প্রতিক্রিয়া করতে পারে?
উত্তর) :
হলুদের মধ্যে থাকা শক্তিশালী উপাদানগুলি কিছু ওষুধের সাথে যোগাযোগ এবং প্রতিক্রিয়া
করতে পারে, বিশেষ করে অ্যান্টি-কোয়াগুলেন্টস, অ্যান্টি-ডায়াবেটিকস এবং কিছু ওষুধ
যারা পাকস্থলীর অ্যাসিডকে প্রভাবিত করতে পারে । হলুদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং
প্রতিক্রিয়ার ফলে এইধরনের ওষুধগুলির কার্যকারিতা পরিবর্তন হতে পারে এবং
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ঝুকি থাকে । তাই এই ধরনের ওষুধগুলি যারা গ্রহণ করছেন,
অতিরিক্তভাবে ডায়েটে হলুদ যোগ করার আগে একবার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া
উচিত ।
৬) হলুদ শোষণ করার সেরা উপায়
কি?
উত্তর) :
গরম পানীয় বা খাবারে হলুদ যোগ করে গ্রহণ করলে এর শোষণ এবং উপকারিতা বেড়ে যায় ।
হলুদের মধ্যে থাকা সক্রিয় উপাদান কারকিউমিনের শোষণ বাড়াতে পিপারিন, অলিভ অয়েল বা
নারকেল তেলের সাথে কালো মরিচ যোগ করে গ্রহণ করলে শরীরে কারকিউমিনের শোষণ বেড়ে যেতে
দেখা গেছে ।
হলুদের বহুমুখী বৈশিষ্ট্য এটিকে লিভারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একটি মূল্যবান উপাদান করে তোলে। আপনার ডায়েটে নিয়মিত অন্তর্ভুক্তি শুধুমাত্র লিভারের কার্যকারিতাকে সমর্থন করে না বরং সামগ্রিক সুস্থতার প্রচার করে। যারা লিভারের অবস্থা পরিচালনা করছেন বা ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের জন্য, নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্যতালিকাগত সমন্বয় করার আগে একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
0 মন্তব্যসমূহ