ক্রিয়েটিনিন হলো এমন একটি শব্দ, যা প্রায়শ:ই কিডনীর স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা সম্পর্কে বারবার উল্লেখ করতেই হয় । কিন্তু এখনো বহু মানুষ এটি কি এবং এর তাৎপর্য কি এবং কোথা থেকে এটি আসে সেই সম্পর্কে সচেতন নন । তাই আমরা এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে চেষ্টা করবো ক্রিয়েটিনিন কি এবং তার প্রকৃতি, শরীরের উপরে এর প্রভাব, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা উচ্চ হলে শরীরে তার কি প্রভাব হতে পারে, শরীরে ক্রিয়েটিনিন স্তরের স্বাভাবিক পরিমাপ, শরীরে ক্রিয়েটিনিন স্তরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন কিছু খাবারের সম্পর্কে আলোচনা করবো । যাতে পাঠক এই ব্লগ পোস্টটি পড়ে ক্রিয়েটিনিন সম্পর্কে সাধারণ কিছু সচেতনতা পেতে পারেন এবং নিজেকে বা নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন ।
ক্রিয়েটিনিন কি
ক্রিয়েটিনিন হলো আমাদের শরীরের পেশী কোষের স্বাভাবিক বিপাকের ফলে নির্গত একটি রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ । সাধারণত:
এটি ক্রিয়েটিন নামক একটি যৌগ, যা পেশীতে শক্তি উৎপাদনের জন্যে জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তার পরিবর্তিত রূপ । আসলে আমরা যখন কোন শারীরিক কার্যকলাপে যুক্ত হই, তখন আমাদের শরীর ক্রিয়েটিনকে পরিবর্তিত করে আমাদের পেশীতে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে এবং সেই প্রক্রিয়ায় ক্রিয়েটিন ক্রিয়েটিনিনে রূপান্তরিত হয় । যা পরে রক্তপ্রবাহে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ।
আর রক্তপ্রবাহ থেকে ক্রিয়েটিনিনকে ফিল্টার করতে কিডনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ,
সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ফিল্টার হওয়ার পরে ক্রিয়েটিনিন প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় । রক্তে ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রা নির্দেশ করে যে, আমাদের কিডনী সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা । তাই বলা যেতে পারে, কিডনীর কার্যকারিতার উপরে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে নির্ভর করে ।
শরীরে ক্রিয়েটিনিনের ভূমিকা
কিডনী আমাদের শরীরের বিভিন্ন পদার্থের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থে সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পক্ষে অতিরিক্ত ক্রিয়েটিনিনকে ফিল্টার করে বের করে দেয় । কিন্তু যখন কিডনীর কার্যকারিতা ব্যাহত হয়, তখন কিডনী কার্যকরভাবে শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলিকে ফিল্টার করে বার করে দিতে পারে না, যার ফলে রক্তে অতিরিক্ত ক্রিয়েটিনিন ধরা পড়ে । সুতরাং বলা যেতে পারে, ক্রিয়েটিনিন বা ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কিডনীর স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার একটি মূল প্রতিফলনকারী পদার্থ হিসাবে কাজ করে । বিভিন্ন কারণ দ্বারা ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা প্রভাবিত হতে পারে, সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আমরা জেনে নেবো ।
১) পেশী ভর – সাধারণত: যেসব মানুষের পেশী ভর বেশি থাকে, তাদের ক্রিয়েটিনিনের বেসলাইনের মাত্রা বেশি হয় । উদাহরণস্বরূপ, অ্যাথলিট বা অন্যান্য ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে, যারা সাধারণত: উচ্চ সহনশীলতার জন্যে ট্রেনিং নেন, সাধারণ মানুষদের থেকে তাদের শরীরের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি হতে পারে ।
২) ডায়েট – যারা সর্বদা ডায়েটে উচ্চ প্রোটিন গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রেও শরীরের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে । কারণ, শরীরের প্রোটিন বিপাক প্রক্রিয়ায় প্রোটিনগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অ্যামাইনো অ্যাসিডে ভেঙে যায়, যার মধ্যে কিছু অ্যামাইনো অ্যাসিড ক্রিয়েটিনিনে রূপান্তরিত হতে পারে ।
৩) হাইড্রেশন লেভেল – ডিহাইড্রেশন শরীরের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রার সাময়িক বৃদ্ধি ঘটাতে পারে, কিন্তু কিডনীর কার্যকারিতা ঠিক থাকলে সঠিক হাইড্রেশন সেই মাত্রা কমাতে সাহায্য করে ।
৪) ওষুধ এবং চিকিৎসা শর্ত – কিছু ওষুধ কিডনীর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে । ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যাগুলিতে ঝুকিপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রয়োগ করা কিছু ওষুধও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে ।
শরীরে উচ্চ ক্রিয়েটিনিন স্তরের প্রভাব
শরীরে ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে কিডনীর ক্ষেত্রে । ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রার জন্যে শরীরের উপরে সম্ভাব্য কিছু প্রভাব সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো –
১) কিডনীর সমস্যা – শরীরে ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রার সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ দিক হলো কিডনীর দীর্ঘস্থায়ী রোগের (CKD – Chronic Kidney Disease) ব্যাপারগুলি । CKD হলো কিডনীর এমন একটি অবস্থা, যেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কার্যকারিতা হারাতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত রেনাল ডিজিজের শেষ পর্যায় (ESRD – End Stage Renal Disease) পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে, যেখানে ডায়ালাইসিস বা কিডনীর প্রতিস্থাপন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে ।
২) ক্লান্তি এবং দুর্বলতা – রক্তে তথা শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা উচ্চ হওয়ার ফল হিসাবে রক্তপ্রবাহে টক্সিন জমা হতে থাকে, যার ফলে স্বাভাবিক ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব হতে পারে । আর এর ফলে দৈনন্দিন কাজমর্ম এবং জীবনযাত্রার স্বাভাবিক মান ব্যাহত হতে পারে ।
৩) তরল ধারণ বা শরীর ফোলা – ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা উচ্চ হওয়ার ফলে, কিডনীকে শরীরের তরল ভারসাম্যের সঙ্গে লড়াই করতে হতে পারে । যার ফলে, শরীর তরল ধারণ করতে পারে । যা অস্বস্তিকরভাবে পা, গোড়ালি এবং পায়ের পাতা ফোলা হিসাবে প্রকাশ পেতে পারে । আর এগুলো আসলে কিডনীর কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়া বা কিডনী খারাপ হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে ।
৪) উচ্চ রক্তচাপ – কিডনী শরীরের রক্ত বা তরল পরিস্রুত করার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে । কিডনীর কার্যকারিতা বিঘ্নিত হলে, রক্তচাপের মাত্রা উচ্চ হতে পারে । শুধু তাই নয়, সেই উচ্চ রক্তচাপ কিডনীর আরো ক্ষতিসাধন করতে পারে । ফলে, শরীরের পক্ষে একটি বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ চক্র তৈরী হতে পারে ।
৫) ক্ষিদে কমে যাওয়া এবং বমি বমি ভাব অনুভব – শরীরের রক্তপ্রবাহে বর্জ্য পদার্থ জমে থাকার জন্যে তা গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টিনাল সিস্টেমকে প্রভাবিত করতে পারে । আর এর লক্ষণ হিসাবে ক্ষিদে কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, এমনকি বমি অবধি হতে পারে । আর এইসব লক্ষণগুলি সামগ্রিক স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ঝুকি ডেকে আনতে পারে ।
৬) হাড়ের সমস্যা – দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রা এবং কিডনীর দুর্বল কার্যকারিতা শরীরের ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাসের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে । যার ফলস্বরূপ, শরীরের হাড় দুর্বল এবং ভঙ্গুর হয়ে উঠতে পারে ।
শরীরে ক্রিয়েটিনিন স্তরের স্বাভাবিক পরিমাপ
ক্রিয়েটিনিন স্তরের স্বাভাবিক পরিমাপ কি তা জানা এবং বোঝা, কিডনীর স্বাস্থ্যের মূল্যায়নের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু মনে রাখতে হবে, বয়স-লিঙ্গ-পেশী ভর এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন দিকগুলোর উপরে নির্ভর করে স্বাভাবিক পরিমাপের মাণগুলি পরিবর্তিত হতে পারে ।
১) পুরুষ – একজন সুস্থ, স্বাভাবিক পুরুষের ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ০.৬ থেকে ১.২ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার (mg/dL) পর্যন্ত হয়ে থাকে ।
২) মহিলা – একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মহিলার ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক পরিসীমা ০.৫ থেকে ১.১ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার (mg/dL) পর্যন্ত হতে পারে ।
৩) শিশু – শিশুদের মধ্যে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা আরো ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে । সাধারণত: শিশুর বয়স এবং আকারের উপর নির্ভর করে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ০.৩ এবং ০.৭ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার (mg/dL), এর মধ্যে পড়ে ।
গুরুত্বপূর্ণভাবে মনে রাখতে হবে যে, এই পরিমাপগুলি পরীক্ষাগারের অবস্থা এবং অন্যান্য কারণ, যেমন – ব্যক্তির হাইড্রেশন পরিস্থিতি,
খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি পরীক্ষার ফলগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে । এইজন্য কিডনীর সামগ্রিক পরিস্থিতি বোঝার জন্যে একজন পেশাদার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সঙ্গে পরমশর্শ করা উচিত । কারণ তিনি অন্যান্য ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা এবং অন্যান্য মূল্যায়নের ভিত্তিতে আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন ।
ক্রিয়েটিনিনের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে কিছু খাদ্য
খাদ্যাভ্যাস কিডনীর স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সেই হিসাবে বলা যেতে পারে, কিডনীর স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এরকম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা ক্রিয়েটিনিনের মাত্রাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । যদিও এইরকম কোন খাদ্য নেই, যা গ্রহণের মাধ্যমে কিডনীর কার্যকারিতাকে বা ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রাকে স্বাভাবিক করতে পারা যায় বা সম্পূর্ণ নিবন্ত্রণ করতে পারা যায় । তবুও কিছু খাদ্য আছে যাদের মাধ্যমে কিডনীর কার্যকারিতাকে যারা সমর্থন করতে পারে বা কিডনীর জন্যে উপকারী হতে পারে ।
১) বেরি (Berry) – বিভিন্ন বেরি, যেমন- ব্লু-বেরি, স্ট্রবেরি এবং রাস্পবেরি কিডনীর স্বাস্থ্যের জন্যে বা কিডনীর কার্যকারিতাকে বজায় রাখার জন্যে দারূণ হতে পারে । কারণ, এদের মধ্যে পটাশিয়াম কম এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট বেশি, ফলে এরা বিভিন্ন প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন কম করতে বা কোষের মধ্যেকার অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করতে সক্ষম । এছাড়া এদের মধ্যে উপস্থিত ফাইবার হজমের উন্নতিতেও সাহায্য করে ।
২) সবুজ শাক-সব্জি (Green vegetables) – পালঙ শাক, কালে এবং সুইস চার্ডের মতো সবুজ শাক-সব্জি গুলি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ দ্রব্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয় এবং সেগুলিতে পটাশিয়াম খুব কম থাকে । ফলে এগুলি গ্রহণের মাধ্যমে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি-উপাদানগুলির সরবরাহ পেয়ে যায়, যা কিডনীর অতিরিক্ত চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হয় ।
৩) ফুলকপি (Cauliflower) – ফুলকপিতে পটাশিয়াম অত্যন্ত কম থাকে এবং এটি ফাইবার, ভিটামিন-সি, ভিটামিন কে এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টে সমৃদ্ধ । ফলে এটি একটি কিডনী বান্ধব সব্জি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে ।
৪) রসুন (Garlic) – রসুন তার অন্যরকম স্বাদের জন্যে অতিরিক্ত লবণের প্রয়োজন ছাড়াই খাবারে অন্যরকম স্বাদ যোগ করতে পারে । তাছাড়াও রসুনের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেশন গুণ এবং এর মধ্যে থাকা অন্যান্য জৈব যৌগগুলি কার্ডিওভাস্কুলার রোগ, যা প্রধানত: কিডনীর সমস্যায় আক্রান্তদের ঝুকির কারণ হয়ে ওঠে, সেগুলি কমাতে সাহায্য করে । ফলে খাদ্যে রসুনের প্রয়োগ বা কাঁচা রসুন খাওয়া কিডনীর স্বাস্থ্যের জন্যে বা ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে ।
৫) অলিভ অয়েল (Olive oil) – অলিভ অয়েলে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরী বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়, যা হার্টের সুস্থতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যা কিডনীর জন্যে অত্যন্ত সহায়ক । অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট বা মাখনের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটযুক্ত অলিভ অয়েল বা জলপাইয়ের তেল হার্ট বা পরোক্ষভাবে কিডনীর সুস্থতার জন্যে একটি দারুণ বিকল্প ।
৬) ফ্যাটযুক্ত মাছ (Fatty fish) – ফ্যাটযুক্ত মাছ, যেমন স্যামন, ম্যাকরেল এবং সার্ডিন জাতীয় মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে । যা শরীরের বিভিন্ন ইনফ্ল্যামেশনকে কমাতে এবং কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমের কার্যকারিতাকে বজায় রাখতে সাহায্য করে । তাছাড়া, এই ধরনের মাছগুলি উচ্চ মানের প্রোটিনের একটি ভালো উৎস এবং পেশী রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সহায়ক । সুতরাং সবদিক মিলিয়ে ফ্যাটযুক্ত মাছগুলিকে কিডনী-বান্ধব খাদ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় ।
৭) ডিমের সাদা অংশ (Egg whites) – ডিমের সাদা অংশটি কুসুমের তুলনায় উচ্চ মানের প্রোটিনের ভালো উৎস এবং এই অংশে কুসুমের চেয়ে ফসফরাসও কম থাকে । যারা উচ্চ প্রোটিনের একটি ভালো উৎস খোজার পাশাপাশি এটাও চান যাতে প্রোটিন গ্রহণের জন্যে কিডনীর উপরে অতিরিক্ত চাপ না পড়ে তাদের জন্যে ডিমের সাদা অংশটি একটি ভালো বিকল্প হতে পারে ।
৮) আপেল (Apple) – আপেল হলো এমন একটি ফল, যা ফাইবারের সঙ্গে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ । শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানর সঙ্গে সঙ্গে এর মধ্যে পটাশিয়ামের কম মাত্রার জন্যে এটি কিডনীর কার্যকারিতার উন্নতিতেও সাহায্য করে ।
৯) লাল বেল মরিচ (Red bell pepper) – লাল বেল মরিচের মধ্যে পটাশিয়ামের পরিমাণ খু্ই কম থাকার পাশাপাশি এতে ভিটামিন এ, সি এবং বি৬ এবং সঙ্গে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট থাকে । যার ফলে এটিকে কিডনী-বান্ধব ডায়েটের জন্যে একটি ভালো সংযোজন হিসাবে উপযোগী করে তুলেছে ।
১০) গোটা শস্য (Whole grains) – কুইনোয়া, বার্লি এবং বাদামী চালের মতো গোটা শস্যগুলি কিডনীর কার্যকারিতাকে প্রতিরোধ না করে প্রোটিনের উচ্চ মাত্রা সরবরাহের পাশাপাশি ফাইবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিও সরবরাহ করে, যারা কিডনী ফাংশন করার সময়ে তার কার্যকারিতাকে সহযোগিতা প্রদান করে ।
প্রায়শ:ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ's)
১) ক্রিয়েটিনিন কী এবং কেন এটি কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর): ক্রিয়েটিনিন হলো শরীরের একটি বর্জ্য পদার্থ যা পেশী বিপাক দ্বারা উৎপন্ন হয় । বিশেষত: ক্রিয়েটাইন নামক যৌগের ভাঙ্গন থেকে এটি উৎপন্ন হয়, যা পেশীগুলির জন্য শক্তি উত্পাদন করতে সহায়তা করে। কিডনি রক্ত থেকে ক্রিয়েটিনিন ফিল্টার করে এবং রক্তের প্রবাহে এর মাত্রা নির্দেশ করতে পারে যে, কিডনি কতটা ভালোভাবে কাজ করছে। ক্রিয়েটিনিনের বেশি মাত্রা প্রায়শ:ই কিডনির কার্যকারিতা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সম্পর্কে জানান দেয় ।
২) স্বাভাবিক ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কি এবং তারা কি বয়স বা লিঙ্গ অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে ?
উত্তর): অবশ্যই, ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ব্যক্তির বয়স, লিঙ্গ এবং পেশী ভরের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে –
(ক) পুরুষ : ০.৬ থেকে ১.২ mg/dL
(খ) মহিলা : ০.৫ থেকে ১.১ mg/dL
(গ) শিশু : ০.৩ থেকে ০.৭ mg/dL ( বয়স এবং আকারের উপর নির্ভর করে ) এই মানগুলি স্বাস্থ্য অনুসারে স্বতন্ত্র হয়, কারণ হাইড্রেশনের মাত্রা এবং পরীক্ষাগারে গৃহীত পদ্ধতির কারণে সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে। একটি সঠিক মূল্যায়নের জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সাথে পরামর্শ করুন।
৩) ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণ কী এবং লক্ষণগুলি কী কী ?
উত্তর) : ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি হতে
পারে কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন -
(ক) কিডনির কার্যকারিতা : দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (CKD) বা কিডনিতে তীব্র আঘাতের মতো কোন অবস্থা ।
(খ) ডিহাইড্রেশন : শরীরের তুলনায় অপর্যাপ্ত তরল গ্রহণ সাময়িকভাবে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে ।
(গ) উচ্চ প্রোটিন খাদ্য : অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ ক্রিয়েটিনিন উৎপাদন বাড়াতে পারে।
(ঘ) কিছু ওষুধ : রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের ওষুধ কিডনির কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে ।
লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, পায়ে ফোলাভাব, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা হ্রাস এবং প্রস্রাবের সমস্যার মতো বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এই সমস্যাগুলি পরিচালনার মূল চাবিকাঠি ।
৪) খাদ্য কি প্রাকৃতিকভাবে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে ?
উত্তর): হ্যাঁ, একটি কিডনি-বান্ধব খাদ্য স্বাস্থ্যকর ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা সমর্থন করতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে-
(ক) কম পটাসিয়ামযুক্ত খাবার : বেরি, আপেল এবং লাল মরিচ।
(খ) প্রদাহ বিরোধী খাবার : রসুন, অলিভ অয়েল এবং স্যামনের মতো চর্বিযুক্ত মাছ।
(গ) কম-ফসফরাস বিকল্প : ডিমের সাদা অংশ এবং ফুলকপি। উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। ব্যক্তিগত পরামর্শের জন্য সর্বদা একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা খাদ্য বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন।
৫) ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা এবং কিডনির স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করতে কোন চিকিৎসা পরীক্ষা ব্যবহার করা হয় ?
উত্তর): ক্রিয়েটিনিন স্তরের মূল্যায়নের জন্য সাধারণ চিকিৎসা পরীক্ষাগুলির মধ্যে রয়েছে-
(ক) সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা : রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা পরিমাপ করে।
(খ) ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স পরীক্ষা : কিডনি কতটা কার্যকরভাবে ক্রিয়েটিনিন ফিল্টার করে তা মূল্যায়ন করে।
(গ) গ্লোমেরুলার পরিস্রাবণ হার (GFR) : বয়স, লিঙ্গ এবং ক্রিয়েটিনিন স্তরের উপর ভিত্তি করে সামগ্রিক কিডনির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে।
ক্রিয়েটিনিন স্তরের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ সম্ভাব্য কিডনি সমস্যা প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
৬) কিভাবে আমি উচ্চ ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা প্রতিরোধ করতে পারি এবং কিডনির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারি ?
উত্তর): আপনার কিডনি সুস্থ রাখতে এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে -
(ক) পর্যাপ্ত জল পান করে হাইড্রেটেড থাকুন।
(খ) ফল, সবজি এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য বজায় রাখুন।
(গ) নিয়মিত ব্যায়াম করুন আর অতিরিক্ত
পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন।
(ঘ) লবণ, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অত্যধিক প্রোটিন গ্রহণ সীমিত করুন।
(ঙ) ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন।
ক্রিয়েটিনিন কি এবং শরীরের উপরে এর প্রভাব কি তা বোঝা নিজেদের এবং অন্যের কিডনীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে বোঝার জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়্ একটি বিষয় । এই সম্পর্কে সচেতনত আমাদের বা আমাদের পরিবারের সদস্যদের জন্যে কিডনী-বান্ধব খাবারগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ক্রিয়েটিনিনের পরিমাপ সম্পর্কে জেনে রাখার ফল হিসাবে যেকোন কারোর কিডনীর ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরী হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে । প্রাথমিক সচেতনতা অনুযায়ী,
ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি বা কিডনী সম্পর্কিত কোনরূপ সন্দেহ বা সংশয় থাকলে কোন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ করুন । কারণ, কিডনীজনিত সমস্যায় প্রাথমিক সিদ্ধান্ত,
হস্তক্ষেপ এবং নিয়মিত মনিটরিং কিডনীর চিকিৎসায় একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য এনে দিতে পারে । এই ব্লগ পোস্টটি পড়ে যদি আপনার ভালো লাগে বা এখানে দেওয়া তথ্য যদি আপনার কাজে আসে তাহলে অন্যদের শেয়ার করার জন্যে অনুরোধ রইলো ।
0 মন্তব্যসমূহ