"প্রোটিন" কথাটা শুনলেই আমাদের মাথায় আসে একটি পেশীবহুল, জিমে ঘাম ঝরানো যুবকের ছবি । কিন্তু প্রোটিন কি শুধুই বডিবিল্ডার বা অ্যাথলিটদের জন্যই ? নাকি আমাদের সবার দৈনন্দিন জীবনেও এর কোন অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে ? আসলে বর্তমান ব্যস্ত জীবনে শুধুমাত্র খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করাটা অনেকের জন্যই খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাড়াচ্ছে । আর সেখানেই উঠে আসছে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট-য়ের প্রসঙ্গ ।
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট : শরীরের জন্য অপরিহার্য নাকি শুধুই ট্রেন্ড?
আমার ব্লগের আজকের এই পোস্টের মাধ্যমে আমরা প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট সম্পর্কে আমার, আপনার মনে আসা সম্ভাব্য সবক’টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো । কেন আপনার দৈনিক জীবনে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট-য়ের প্রয়োজন হতে পারে, কিভাবে বাছবেন, কি কি সতর্কতা মেনে চলবেন – সবকিছুই বিশদভাবে আলোচনা করবো ।
প্রোটিনকে আমাদের শরীরের "বিল্ডিং ব্লক" বলা হয় কেন ?
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট কি সেটা বোঝার আগে বুঝে নেওয়া দরকার প্রোটিনকে । এককথায় বলতে গেলে প্রোটিন হলো অ্যামাইনো অ্যাসিড নামক ছোট্ট ছোট্ট অণু দ্বারা গঠিত একটি জটিল যৌগ । আর অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলোই হলো শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ।
প্রোটিনের প্রধান কাজগুলো হলো নিম্নরূপ :
পেশী গঠন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত : আমরা যখন ব্যায়াম করি, বিশেষ করে ওয়েট ট্রেনিং বা স্ট্রেন্থ ট্রেনিং, তখন আমাদের পেশীতন্তুগুলিতে অতি সূক্ষ্ম চিড় ধরে। প্রোটিন সেই চিড় সারিয়ে তোলার কাজ করে এবং তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে পেশীকে পুনর্গঠিত করে। এটি শুধু বডিবিল্ডারদের জন্য নয়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রাকৃতিকভাবে যে পেশী ক্ষয় (Sarcopenia) হয়, তা রোধ করতেও প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এনজাইম ও হরমোন উৎপাদন : আমাদের শরীরে প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। এই প্রতিক্রিয়াগুলোকে সঠিক গতিতে ও সঠিকভাবে পরিচালনা করে এনজাইম, যা আসলে এক ধরনের প্রোটিন। একইভাবে, ইনসুলিন, গ্রোথ হরমোনের মতো হরমোনগুলিও প্রোটিন দিয়ে তৈরি, যা আমাদের শরীরের বৃদ্ধি, বিকাশ ও বিপাক নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা : আমাদের রক্তে থাকা অ্যান্টিবডি, যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেগুলোও বিশেষ ধরনের প্রোটিন (ইমিউনোগ্লোবুলিন)। তাই শরীরে পর্যাপ্ত প্রোটিন না থাকলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
শরীরের গঠন ও টিস্যু মেরামত : প্রোটিন শুধু পেশীতেই থাকে না, এটি আমাদের হাড়, ত্বক, চুল, নখ এবং অন্যান্য কানেক্টিভ টিস্যুরও একটি মূল গঠনমূলক উপাদান। কোলাজেন, যা আমাদের ত্বককে টানটান রাখে এবং জয়েন্টগুলোকে সুস্থ রাখে, সেটিও একটি প্রোটিন।
পরিপাক ও পরিবহন : রক্তে অক্সিজেন বহনকারী হিমোগ্লোবিন একটি প্রোটিন। বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদানকে রক্তের মাধ্যমে বয়ে নিয়ে যাওয়াও কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিনের কাজ ।
খিদে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ : প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার আমাদের খিদের জন্য দায়ী হরমোন (ঘ্রেলিন) কমাতে এবং পূর্ণতার হরমোন (লেপটিন) বাড়াতে সাহায্য করে। যার দরুন আপনি অনেক্ষণের জন্য পেট ভর্তির বোধ করেন, যা আপনার সার্বিক ক্যালোরি গ্রহণ কমাতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
কখন প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যৌক্তিক?
প্রাকৃতিক খাবারই হলো প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস। কিন্তু বাস্তব জীবনে নিম্নলিখিত পরিস্থিতির জন্য প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ একজন বিবেচকের মতো কাজ হতে পারে :
১) নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম : আপনি যদি একজন নিয়মিত জিম করেন বা অ্যাথলিট হন বা কোন ম্যারাথন রানার হন বা যেকোন কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাহলে আপনার পেশী মেরামত ও বৃদ্ধির জন্য শরীরের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। শুধু খাবার দিয়ে সেই চাহিদা মেটানো কঠিন হতে পারে।
২) ব্যস্ত জীবনযাত্রা ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : অফিসের কাজ, মিটিং, ট্রাফিকে সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া – এই ব্যস্ততার মধ্যে অনেকের পক্ষেই সময় করে প্রোটিন সমৃদ্ধ সুষম খাবার বানানো ও খাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে, শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট একটি দ্রুত ও সহজ সমাধান।
৩) বয়সজনিত পেশী ক্ষয় (Sarcopenia) : ৩০ বছর বয়সের পর থেকে আমাদের শরীর প্রাকৃতিকভাবেই নিজের পেশী ভর হারাতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া রোধ করতে এবং সক্ষমতা বজায় রাখতে বয়স্ক ব্যক্তিদেরও বেশি প্রোটিনের প্রয়োজন হয়, যা তারা অনেক সময় খাবার থেকে পুরোপুরি পায় না।
৪) ভেগান বা কঠোর নিরামিষাশী : প্রাণিজ উৎস (মাংস, ডিম, দুধ) হলো সম্পূর্ণ প্রোটিনের ভালো উৎস। যারা ভেগান, তারা শুধু উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খান, যার মধ্যে অনেকেরই পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে না। এই ক্ষেত্রে, একটি ভালো মানের উদ্ভিজ্জ প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট (যেমন মটর বা সয় প্রোটিন) তাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে সাহায্য করতে পারে।
৫) স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিশেষ অবস্থা : কোনো গুরুতর অসুস্থতা বা কোন অপারেশনের পরে, কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোন আঘাত থেকে সেরে ওঠার সময় শরীরের প্রোটিনের চাহিদা অনেক গুণ বেড়ে যায়। সেইসব ক্ষেত্রে ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের পরামর্শে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।
৬) ওজন কমানোর ডায়েট : যারা ওজন কমানোর জন্য কম ক্যলোরিযুক্ত ডায়েট অনুসরণ করছেন, সেই ডায়েটে প্রোটিনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট কম ক্যালোরি-তে উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহ করে, যা পেশী ক্ষয় রোধ করে এবং পেট ভরিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
বাজারের সেরা প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট এর ধরন : একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বাজারে এত ধরনের প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট দেখে ঘাবড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। জেনে নিন সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি প্রোটিন সম্পর্কে -
১) হোয়ে প্রোটিন (Whey Protein)
উৎস : পনির তৈরির প্র্রক্রিয়ায় দুধ থেকে আলাদা করা একটি উপজাত দ্রব্য।
সুবিধা :
- দ্রুত শোষিত হয়, তাই ব্যায়ামের পর এটি খাওয়ার জন্য আদর্শ।
- সমস্ত প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডে ভরপুর, বিশেষ করে লিউসিন, যা পেশী গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে।
- বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা কার্যকারিতা প্রমাণিত, সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রোটিন ।
অসুবিধা :
- যাদের ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা আছে, তাদের জন্য ঘন (concentrated) মাধ্যমে সমস্যা হতে পারে (এই ক্ষেত্রে আইসোলেট নেওয়া ভালো)।
- দুগ্ধজাত পণ্যে অ্যালার্জি থাকলে এড়িয়ে চলুন।
২) কেসিন প্রোটিন (Casein Protein)
উৎস : দুধের মধ্যে থাকা প্রধান প্রোটিন।
সুবিধা :
- ধীরে ধীরে শোষিত হয় (৪-৬ ঘন্টা), তাই শরীরকে দীর্ঘক্ষণ অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে।
- রাতে ঘুমানোর আগে খাওয়ার জন্য খুব ভালো, কারণ ঘুমের সময় দীর্ঘক্ষণ পেশীকে পুষ্টি জোগায়।
অসুবিধা :
- হোয়ে-র মতো দ্রুত কাজ করে না।
- এটি দুগ্ধজাত, তাই যাদের ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা আছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।
৩) সয়া প্রোটিন (Soy Protein)
উৎস : সয়াবিন।
সুবিধা :
- গাছ থেকে প্রাপ্ত "সম্পূর্ণ প্রোটিন", অর্থাৎ এতে সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড (Essential Amino Acids) রয়েছে।
- হোয়ে প্রোটিনের সেরা উদ্ভিজ্জ বিকল্প।
- কিছু গবেষণায় এটিকে হার্টের স্বাস্থ্য এবং কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক দেখা গেছে।
অসুবিধা :
- কিছু মানুষের সয়ে অ্যালার্জি থাকে।
- সয়াতে উদ্ভিদজাত ইস্ট্রোজেন থাকে, যার প্রভাব নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে (যদিও অধিকাংশ গবেষণায় এটি নিরাপদ বলে প্রমাণিত)।
৪) মটর প্রোটিন (Pea Protein)
উৎস : হলুদ মটর (Pea) ।
সুবিধা :
- হাইপোঅ্যালার্জেনিক, অর্থাৎ যাদের দুগ্ধজাত দ্রব্য বা সয়াতে অ্যালার্জি, তাদের জন্য উত্তম।
- হজম করা খুব সহজ ।
- আর্জিনাইন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিডে ভরপুর, যা রক্ত চলাচল ও পেশী গঠনে সাহায্য করে।
অসুবিধা :
- মেথিওনাইন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিডের ঘাটতি থাকতে পারে, তাই অনেক ব্র্যান্ড এটি ব্রাউন রাইস প্রোটিনের সঙ্গে মিশিয়ে সম্পূর্ণ প্রোটিন করে তোলে ।
৫) রাইস প্রোটিন (Rice Protein)
উৎস : বাদামী চাল (Brown Rice)।
সুবিধা : হাইপোঅ্যালার্জেনিক এবং হজমে সহায়ক ।
অসুবিধা : লাইসিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিডের ঘাটতি থাকে, তাই এটি সাধারণত: মটর প্রোটিনের সাথে মিশ্রিত হয়ে বিক্রি হয়।
কোন প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট আপনার জন্য সঠিক ?
বাজারে নানা রকমের প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায় । আপনি জেনে নিন সেরা কয়েকটির বৈশিষ্ট্য :
|
প্রোটিনের ধরন |
উৎস |
সুবিধা |
অসুবিধা |
|
হোয়ে প্রোটিন |
গরুর দুধ |
দ্রুত শোষণযোগ্য, সম্পূর্ণ অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল |
ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্টদের জন্য সমস্যাযুক্ত |
|
কেসিন প্রোটিন |
গরুর দুধ |
ধীরে শোষিত হয়, দীর্ঘক্ষণ পেশীতে অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে |
হোয়ে প্রোটিনের মতো দ্রুত কাজ করে না |
|
সয়া প্রোটিন |
সয়াবিন |
গাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ প্রোটিন, হোয়ের ভালো বিকল্প |
কিছু মানুষের সয়াতে অ্যালার্জি থাকতে পারে |
|
মটর প্রোটিন |
মটর |
হাইপোঅ্যালার্জেনিক, হজমে সহায়ক |
স্বাদ কিছুটা মটরসম হতে পারে |
|
রাইস প্রোটিন |
ব্রাউন রাইস |
হাইপোঅ্যালার্জেনিক |
অসম্পূর্ণ অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল |
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট এর অন্ধকার দিক : যে সতর্কতাগুলো আপনি না জানলেই বিপদ!
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট যেমন উপকারী, তেমনই এর কিছু সম্ভাব্য ঝুকি এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
১) কিডনীর উপর অতিরিক্ত চাপ : শরীরে প্রোটিন ভাঙার প্রক্রিয়া চলাকালীন ইউরিয়া ও অন্যান্য বর্জ্য তৈরী হয়, যা কিডনী পরিস্রাবণ (filtration)প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বের করে দেয়। যাদের আগে থেকে কিডনীর সমস্যা আছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ কিডনীর চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং কিডনীর সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
২) হজমের সমস্যা : বহু মানুষের জন্যই হোয়ে প্রোটিনের ঘন ল্যাকটোজ হজম করা শক্ত হয়ে ওঠে, যার জন্য তাদের পেট ফাঁপা, গ্যাস বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে । অনেক সময় প্রোটিনে মিশ্রিত কিছু কৃত্রিম মিষ্টি করার উপাদান (যেমন-সোরবিটল) থেকেও এই ধরণের সমস্যা হয়।
৩) কৃত্রিম উপাদানের উপস্থিতি : অনেক নিম্নমানের প্রোটিন সাপ্লিমেন্টে স্বাদ বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম মিষ্টতা, রং, ঘন করার উপাদান (thickeners) ইত্যাদি মেশানো হয়, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করলে এগুলি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য চরম বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ।
৪) দূষণের ঝুঁকি : কিছু সস্তার ও নিম্নমানের প্রোটিন পাউডারে ভারী ধাতু (সীসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম) এবং ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় । এই ধাতুগুলো শরীরে জমে কার্সিনোজেনিক (carcinogenic) হয়ে উঠতে পারে ।
৫) অবাঞ্ছিত ওজন বৃদ্ধি : মনে রাখবেন, প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট হলো একটি খাবার, কোন যাদু পা্উডার নয় । এতে ক্যালোরী থাকে, সুতরাং আপনি যদি আপনার দৈনিক প্রয়োজনীয়তার চেয়ে বেশি ক্যালোরী গ্রহণ করেন (প্রোটিন সাপ্লিমেন্টসহ), তাহলে আপনার ওজন বাড়বেই ।
৬) হাড়ের ক্ষয় –একটি ভুল ধারণা : একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে, বেশি প্রোটিন খেলে হাড় থেকে ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায় । কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম এবং পরিমিত প্রোটিন গ্রহণের ফলে হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে ।
কিভাবে নিরাপদে ও সঠিকভাবে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করবেন?
ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে সর্বোচ্চ উপকার পেতে এই পদক্ষেপগুলোকে অনুসরণ করুন -
প্রাকৃতিক খাবারকে অগ্রাধিকার দিন : সাপ্লিমেন্ট মানেই হলো "যোগ"। আপনার মূল খাবারই হওয়া উচিত প্রোটিন সমৃদ্ধ – ডিম, মুরগির বুকের মাংস, মাছ, দই, ডাল, বাদাম ইত্যাদি।
সঠিক ডোজ নির্ধারণ করুন : আপনার শরীরের ওজনের প্রতি কেজির জন্য দৈনিক ১.২ থেকে ২.০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ একজন সক্রিয় ব্যক্তির জন্য পর্যাপ্ত । একজন পুষ্টিবিদের সাহায্যে আপনার সঠিক চাহিদা বের করুন। সাধারণত, একটি স্কুপে ২০-২৫ গ্রাম প্রোটিন থাকে, যা একবারে গ্রহণের জন্য যথেষ্ট।
ব্র্যান্ড বাছাইয়ে সচেতন হোন : শুধু দাম দেখে কিনবেন না। এমন ব্র্যান্ড পছন্দ করুন যাদের পণ্যের লেবেলে তৃতীয় পক্ষের ল্যাব পরীক্ষার ফলাফল উপলব্ধ (যেমন - Informed Choice বা NSF সার্টিফিকেশন) । এগুলি পণ্যের মান ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়।
ভালো করে লেবেল পড়ুন : ভালো করে লেবেলে উপাদন তালিকা দেখে নিন । যেসব পন্যে কৃত্রিম মিষ্টি, রং বা ফিলার কম, সেগুলো পছন্দ করুন ।
পর্যাপ্ত জল পান করুন : বেশি প্রোটিন খাওয়ার সময় শরীরে যাতে বর্জ্য পদার্থ জমে না থাকে, তার জন্য প্রচুর পরিমাণে জল পান করা অত্যাবশ্যক।
ডাক্তারের পরামর্শ নিন : যদি আপনার আগে থেকেই কোন অসুখ থাকে (বিশেষ করে কিডনী বা লিভারের রোগ), তাহলে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে তবেই প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা শুরু করুন ।
সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ's)
১) প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট না খেয়ে কি প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রোটিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব?
উত্তর ) : অবশ্যই সম্ভব এবং সেটিই স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো । আপনি যদি নিয়মিত ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, দই, ডাল, সয়াবিন, বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের বীজ আপনার খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন, তাহলে আপনার প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট-র কোনো প্রয়োজনই পড়বে না।
২) প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খেলেই কি পেশী বড় হবে?
উত্তর ) : প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট কিন্তু পেশী গড়ে না, এটি শুধুমাত্র পেশী গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (অ্যামিনো অ্যাসিড) সরবরাহ করে । তাই পেশী বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলো – (ক) নিয়মিত এবং সঠিক ধরনের অনুশীলন (রেজিস্ট্যান্স/(ওয়েট ট্রেনিং) এবং (খ) পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম ।
৩) দিনে কতটা প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়া নিরাপদ?
উত্তর ) : নিরাপদ প্রোটিনের মাত্রা ব্যক্তি বিশেষে তার শারীরিক অনুযায়ী আলাদা । আপনার শরীরের ওজন, কাজকর্মের ধরন এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর এটি নির্ভর করে। সাধারণ নির্দেশিকা অনুযায়ী, একবারে ২০-৩০ গ্রামের বেশি প্রোটিন শরীর কার্যকরীভাবে প্রসেস করতে পারে না। তাই দিনে ১-২ স্কুপ প্রোটিন-ই যথেষ্ট । তবে, কোন পুষ্টিবিশারদের কাছ থেকে নিজস্ব উপদেশ নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ ।
৪) গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়েরা কি প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নিতে পারবেন?
উত্তর ) : মহিলাদের গর্ভাবস্থা ও স্তন্যপান করানো একটি স্পর্শকাতর সময় । এই সময়ে যেকোনো প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট বা অন্য কোনো সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে । এই সময়ে প্রাকৃতিক ও পুষ্টিকর খাবার থেকেই প্রোটিনের চাহিদা মেটানো সবরচয়ে ভালো ।
৫) প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট কি লিভারের ক্ষতি করে?
উত্তর ) : যারা লিভার সিরোসিসে ভুগছেন বা যাদের লিভারের কোন গুরুতর রোগ রয়েছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিন ক্ষতিকারক হতে পারে, কারণ এটি হেপাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি (hepatic encephalopathy)-র ঝুকি বাড়াতে পারে । কোন সুস্থ লিভার সম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরিমিত প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নেওয়া সাধারণত নিরাপদ।
৬) কিশোর-কিশোরীরা কি প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নিতে পারে?
উত্তর ) : কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস হলো সুষম খাবার। তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রাকৃতিক খাবার থেকে প্রাপ্ত পুষ্টিই সর্বোত্তম । তাদের প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার আগে কোন শিশু চিকিৎসক বা শিশু পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া বাধ্যতামূলক ।
তাহলে আপনার জন্য প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজনীয় কি না?
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট সুস্থতার, সক্ষমতার জন্যে একটি শক্তিশালী টুল হতে পারে, কিন্তু এটি কোনো জাদুর ছড়ি নয়। এটি আপনার জীবনযাত্রার জন্যে প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করতে পারে, কিন্তু কখনো এটি একটি স্বাস্থ্যকর, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের বিকল্প নয় । আপনি যদি একজন সক্রিয় ব্যক্তি হন, যার দৈনন্দিন খাবার থেকে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয় না, তাহলে একটি উচ্চ গুণমানসম্পন্ন প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট আপনার ফিটনেস যাত্রাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে । মনে রাখতে হবে সচেতন পছন্দ, সঠিক ব্যবহার এবং একটি সুস্থ জীবনযাত্রা্ই হলো সামগ্রিক সাফল্যের চাবিকাঠি।

0 মন্তব্যসমূহ