Header Ads Widget

লিভার সিরোসিস : কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং ঘরোয়া প্রতিকার


লিভার সিরোসিস লিভারের একটি গুরুতর সমস্যা । এই সমস্যার শুরুতে লিভারের আভ্যন্তরীণ দেওয়ালে দাগ হয় যা ধীরে ধীরে মারাত্মক ঘায়ের আকার নিতে পারে  এবং লিভারের সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে বাধা দেয় । আর এই প্রগতিশীল সমস্যাটি প্রায়শ:ই বছরের পর বছর ধরে বিকাশ লাভ করে এবং লিভারের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত নীরবে শরীরকে প্রভাবিত করে । এই ব্লগ পোস্টে, আমরা লিভার সিরোসিস কী, লিভার সিরোসিসের কারণ, লিভার সিরোসিসের লক্ষণ, মহিলা লিভার সিরোসিসের লক্ষণ, অ্যালকোহলযুক্ত লিভার সিরোসিসের লক্ষণ, লিভার সিরোসিসের 4টি স্তর, লিভার সিরোসিসের বিপদ, লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা, কিছু ঘরোয়া প্রতিকার দ্বারা লিভার সিরোসিস থেকে কীভাবে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করব । লিভার সিরোসিস সম্পর্কে সচেতন হলে, কেউ তার নিজের এবং তার পরিবারের কারোর জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে এবং সেটাই আমাদের এই ধরনের লেখার উদ্দেশ্য ।

লিভার সিরোসিস কি

সিরোসিস হল লিভারের দাগ (ফাইব্রোসিস) এর চূড়ান্ত পর্যায়, যা লিভারের অন্যান্য সমস্যার জন্যে এবং সিরোসিস ও অ্যালকোহলিজমের মতো অবস্থার কারণে এর বিকাশ ঘটে । লিভার অনেক শারীরিক কাজের জন্য অত্যাবশ্যক, যার মধ্যে শরীরের ক্ষতিকারক পদার্থগুলিকে ডিটক্সিফাই করা, রক্ত ​​পরিষ্কার করা এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি-উপাদান গুলি খাদ্য থেকে শোষণ করা । যখন সিরোসিস হয়, তখন লিভারের সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং লিভারের কার্যক্ষমতাকে ধীরে ধীরে বাধাগ্রস্ত করে । সমস্যাটির বিকাশের সাথে সাথে এটি লিভার ফেলিওর এবং লিভার ক্যান্সার সহ বিভিন্ন গুরুতর প্রাণনাশক জটিলতার  সৃষ্টি করতে পারে ।

লিভার সিরোসিসের কারণ

লিভার সিরোসিসের কারণগুলি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে সবচেয়ে সাধারণ কিছু কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

১) অ্যালকোহলের সেবন : দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মদ্যপান সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ । দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে লিভারের উপরে চাপ সৃষ্টি হয় এবং লিভারের প্রদাহ শুরু হয় এবং সিরোসিসের বিকাশ ঘটায় ।

২) ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস : হেপাটাইটিস বি এবং সি হল ভাইরাল সংক্রমণ যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ফলে লিভারের প্রদাহ শুরু হতে পারে, যার ফলে সিরোসিসের বিকাশ ঘটতে পারে ।

৩) নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) : এই অবস্থাটি ঘটে যখন অ্যালকোহল সেবন ছাড়াই লিভারে ফ্যাট জমা হয় এবং সিরোসিসের সমস্যার দিকে  অগ্রসর হতে পারে । বিশেষ করে স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং বিপাকীয় সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায় ।

৪) অটোইমিউন হেপাটাইটিস : হেপাটাইটিসের অটোইমিউন অবস্থায়, শরীরের নিজস্ব  ইমিউন সিস্টেম লিভারের কোষকে আক্রমণ করে । যার ফলে প্রদাহ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত সিরোসিস হয় ।

৫) পিত্তথলির সমস্যা : পিত্তনালীর বিভিন্ন সমস্যা যেমন -প্রাইমারি বাইলিয়ারি কোলাঞ্জাইটিস এবং প্রাইমারি স্ক্লেরোসিং কোলাঞ্জাইটিসের মতো অবস্থাগুলি পিত্তকে লিভারে ব্যাক-আপ করে লিভারের টিস্যুর ক্ষতি করে এবং লিভার সিরোসিসের দিকে ঠেলে দেয় ।

৬) জিনঘটিত সমস্যা : জিনঘটিত কিছু কিছু সমস্যা লিভার সিরোসিসের দিকে লিভারকে ঠেলে দেয়, যেমন- হিমোক্রোমাটোসিস (আয়রন জমা হওয়া) এবং উইলসন ডিজিজ (কপার জমা হওয়া) ।

৭) ওষুধ এবং টক্সিন : নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ এবং শরীরে টক্সিনের প্রভাব লিভারের ক্ষতি করতে পারে এবং সিরোসিসের কারণ হয়ে উঠতে পারে ।

লিভার সিরোসিসের লক্ষণ

একদম প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার সিরোসিসের লক্ষণগুলি এতোই সাধারণ সমস্যা হিসাবে পরিলক্ষিত হয় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব আকর্ষণ করে না । কিন্তু সমস্যার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বা লিভার উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত সেইরকম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ দেখা দেয় না । কিছু সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে –

১) ক্লান্তি বোধ করা : ক্লান্তি বোধ করা বা শক্তির অভাবের অনুভূতি হওয়া ।

২) জন্ডিস : লিভারে পিত্ত জমা হওয়ার কারণে ত্বক এবং চোখের হলুদ হওয়া

৩) ফোলা : পা, গোড়ালি এবং পেটে শোথ হওয়া বা ফোলা ।

৪) ত্বকে চুলকানি : স্পষ্ট কারণ ছাড়া ক্রমাগত চুলকানি অনুভব করা ।

৫) বমি বমি ভাব এবং খিদে কমে যাওয়া : পেটে অস্বস্তি, বমি বমি ভাব অনুভব করা এবং খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া ।

৬) রক্তপাত এবং রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা : রক্ত ​​জমাট বাঁধতে লিভারের ভূমিকার কারণে রক্তপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ।

৭) বিভ্রান্তি বা চিন্তা করতে অসুবিধা : রক্তপ্রবাহে টক্সিন জমা হওয়ার কারণে হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি ঘটতে পারে । যার ফলে বিভ্রান্তি বা চিন্তা করতে অসুবিধা হয় ।

মহিলা লিভার সিরোসিসের লক্ষণ

যদিও লিভার সিরোসিসের সাধারণ লক্ষণগুলি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে কিছু সূক্ষ্ম পার্ধক্য দেখা যেতে পারে । যেমন -

১) অনিয়মিত পিরিয়ডস : লিভারের কর্মক্ষমতার অভাবে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে পিরিয়ড মিসড্ হওয়া বা ঋতুচক্রের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে ।

২) ওষুধের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি : বিপাকের পার্থক্যের কারণে মহিলারা ওষুধের প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে পারে।

৩) অটোইমিউন অবস্থার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া : মহিলাদের অটোইমিউন লিভার রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা সিরোসিসে অবদান রাখতে পারে।

অ্যালকোহলযুক্ত লিভার সিরোসিসের লক্ষণ

অ্যালকোহলিক লিভার সিরোসিস বলতে দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল সেবনের ফলে হওয়া  সিরোসিসকে বোঝায় । এই ধরনের সিরোসিসে নীচের উপসর্গগুলি দেখা যেতে পারে ।

১) পেটে তীব্র  ব্যথা : পেটে তীব্র ব্যথা হয়, বিশেষ করে উপরের ডান চতুর্ভুজ অংশে ।

২) ওজন কমে যাওয়া : অনির্দিষ্ট কারণে ওজন কমে যায় ।

৩) ঘন প্রস্রাব হওয়া : লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যা্ওয়ার কারণে ঘন প্রস্রাব হওয়া ।

৪) পামার এরিথেমা : রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে হাতের তালুতে লালচে ভাব দেখা দেয় ।

লিভার সিরোসিসের ৪ টি পর্যায়

লিভার সিরোসিস হলো লিভারের একটি প্রগতিশীল সমস্যা, যাকে সাধারণত লিভারের ক্ষতি এবং কর্মহীনতার তীব্রতা অনুযায়ী চারটি পর্যায়ে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় । এই পর্যায়গুলিকে বোঝার মাধ্যমে লিভার সিরোসিসের অবস্থা বোঝা এবং তার জটিলতাগুলো প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতে পারে ।

লিভার সিরোসিস পর্যায়

বৈশিষ্ট্য : এটি লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায় । লিভারে দাগ থাকা সত্ত্বেও তখনো  লিভার তুলনামূলকভাবে ভালোই কাজ করে । এই পর্যায়ের রোগীদের মধ্যে সেরকম কোন লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা নাও যেতে পারে ।

উপসর্গ : এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশিরভাগই উপসর্গবিহীন থাকে, কিন্তু কিছু ব্যক্তি হালকা ক্লান্তি বা অস্বস্তি অনুভব করতে পারেন ।

পূর্বাভাস : এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার তখনো লিভারের ক্ষতিপূরণ করতে পারে এবং বহু মানুষ উল্লেখযোগ্য জটিলতা ছাড়াই বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে ।

লিভার সিরোসিস পর্যায়

বৈশিষ্ট্য : এই পর্যায়ে লিভারের ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়, যার ফলে পোর্টাল শিরায় চাপ বেড়ে যায় (পোর্টাল হাইপারটেনশন) এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জটিলতা দেখা দিতে পারে।

উপসর্গ : যদিও অনেকের মধ্যে এই পর্যায়েও তেমন উপসর্গ না থাকলেও, কারো কারো মধ্যে পেট ফুলে যাওয়া (অ্যাসাইটস), ভেরিসেস (বর্ধিত শিরা) এবং মাঝে মাঝে হালকা জন্ডিসের মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে ।

পূর্বাভাস : এই পর্যায়েও সমস্যাটির নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা সম্ভব, তবে আরো বেশি জটিলতা প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য ।

লিভার সিরোসিস পর্যায়

বৈশিষ্ট্য : এই পর্যায়ে লিভার আর নিজের ক্ষতির ক্ষতিপূরণ করতে পারে না, যা লিভারকে  উল্লেখযোগ্য জটিলতার দিকে নিয়ে যায় ।

লক্ষণ : এই পর্যায়ে রোগী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষণ অনুভব করতে পারে । যেমন -

• গুরুতর অ্যাসাইটস

• জন্ডিস

• পা ও পেট ফুলে যাওয়া

• বিভ্রান্তি বা পরিবর্তিত মানসিক অবস্থা (হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি)

• কোগুলোপ্যাথির কারণে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়

পূর্বাভাস : এই পর্যায়ের জটিলতাগুলি প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত এনে দিতে পারে এবং এর নিয়ন্ত্রণের জন্যে সাধারণত নির্দিষ্ট উপসর্গগুলির মোকাবেলা করা এবং প্রয়োজনে লিভার প্রতিস্থাপনও করতে হতে পারে ।

লিভার সিরোসিস পর্যায়

বৈশিষ্ট্য : এই পর্যায়টি সম্ভবত: সিরোসিসের চূড়ান্ত পর্যায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পর্যায়ে লিভার আর তার প্রয়োজনীয় কাজগুলি সম্পাদন করতে সক্ষম হয় না এবং লিভার ফেলিওর হয়ে যায় ।  

উপসর্গ : এই পর্যায়ের রোগীদের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে - 

• গুরুতর জন্ডিস

• ব্যাপক অ্যাসাইটস

• হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি (বিভ্রান্তি, অলসতা বা কোমা)

• কিডনি ব্যর্থতা (হেপাটোরেনাল সিন্ড্রোম)

• সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া

পূর্বাভাস : উপসর্গগুলির নিয়ন্ত্রণ এবং জীবনের মান উন্নত করার জন্যে্ উপসর্গগুলির উপশম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । শেষ অবধি লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা থাকে না ।

লিভার সিরোসিসের বিপদ

লিভার সিরোসিস একটি গুরুতর সমস্যা, যা শেষ অবধি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জটিলতা এবং প্রাণনাশের ঝুঁকির কারণ অবথি হতে পারে । এখানে লিভার সিরোসিসের সাথে সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য বিপদ বা ঝুঁকির কথা আলোচনা করা হলো -

১) লিভার সিরোসিস ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যায় -

ক) লিভার সিরোসিস উল্লেখযোগ্যভাবে লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে, বিশেষ করে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা (HCC) ।সিরোসিসে দীর্ঘস্থায়ী লিভারের ক্ষতির ফলে অত্যধিক অ্যালকোহল সেবনের কারণে, ভাইরাল হেপাটাইটিস বা অন্যান্য লিভারের রোগের কারণে লিভার ক্যান্সারের ঝুকি বাড়ে । কারণ, লিভার সিরোসিসের ক্রমবর্ধমান ক্ষতি লিভারের কোষের গঠন এবং কার্যকারিতায় পরিবর্তন আনতে পারে ।

খ) লিভারের ভিতরে আঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসাবে, লিভার নিজেকে মেরামত করার চেষ্টা করে, যার ফলে টিস্যু পুনরুৎপাদনকারী নোডুলস তৈরি হয় । এই নোডুলসগুলির মধ্যে কিছু ডিসপ্লাস্টিক হয়ে উঠতে পারে, যার ফল হিসাবে তারা অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে,  যা ধীরে ধীরে ক্যান্সারের দিকে অগ্রসর হতে পারে ।

গ) সিরোসিসের সাথে যুক্ত দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ লিভার কোষের জেনেটিক মিউটেশন ঘটাতে পারে । এই মিউটেশনগুলির ফলস্বরূপ ক্যান্সারের বিকাশের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে ।

ঘ) লিভার সিরোসিসে হেপাটাইটিস বি এবং সি-য়ের সংক্রমণের মতো কারণগুলির জন্যে লিভারে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় । লিভার সিরোসিসে এইসব সংক্রমণে ভাইরাস খুব সহজেই সরাসরি কোষের পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যা ক্যান্সারের বিকাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে ।

২) লিভার ফেলিওর সিরোসিস বাড়ার সাথে সাথে লিভার তার প্রয়োজনীয় কাজ করার ক্ষমতা হারাতে পারেএর ফলে প্রাণনাশের সম্ভাবনা অবধি থাকতে পারে এবং লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন পর্যন্ত হতে পারে ।

৩) কিডনির ক্ষতি – লিভার সিরোসিস কিডনির কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা হেপাটোরেনাল সিনড্রোম নামে পরিচিত । এই গুরুতর জটিলতার ফলে কিডনির ক্ষতি হয়, এমনকি কিডনী ফেলিওর পর্যন্ত হতে পারে ।

৪) পোর্টাল হাইপারটেনশন - সিরোসিসের কারণে পোর্টাল শিরা, যা পরিপাক অঙ্গ থেকে লিভারে রক্ত ​​বহন করে নিয়ে যায়, তাতে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে । এই অবস্থা খাদ্যনালী এবং পাকস্থলীতে বর্ধিত শিরার (varices) বিকাশের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা ফেটে যেতে পারে এবং প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে।

৫) হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি – সিরোসিসের ফলে লিভার রক্ত ​​থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলিকে ফিল্টার করতে লিভারের অক্ষম হয়ে পড়ে এবং তার ফলে শরীরে বিভিন্ন  ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হতে পারে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে অবধি প্রভাবিত করতে পারে । মস্তিষ্কের এই অবস্থায় বিভ্রান্তি, চেতনা পরিবর্তিত হওয়া, এমনকি কোমা পর্যন্ত হতে পারে ।

৬) রক্তপাতজনিত সমস্যা - লিভার রক্ত ​​জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করে । কিন্তু সিরোসিস এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে আঘাত বা অস্ত্রোপচারের ফলে হওয়া ক্ষত সহজে নিরাময় হতে চায় না ।

৭) অ্যাসাইটস - রক্তনালীতে চাপ বৃদ্ধি এবং লিভার দ্বারা প্রোটিন উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পেটের পেটের গহ্বরে তরল জমা হতে পারে, এ্ই অবস্থাকে অ্যসাইটস বলে ।এর ফলে অস্বস্তি, সংক্রমণ এবং আরো বিভিন্ন রকমের জটিল সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ।

৮) সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া - সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে, যা আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাকটেরিয়াল পেরিটোনাইটিস (পেটের তরলের সংক্রমণ) এবং নিউমোনিয়া সহ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে ।

লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা

লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা মূলত: এর লক্ষণগুলিকে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ করা এবং সমস্যাটি যাতে আরো ক্ষতির দিকে না যেতে পারে তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা করার উপরে নির্ভর করে । বিভিন্নভাবে্ এ্ই ক্ষতিগুলোর নিয়ন্ট্রণ এবং প্রতিরোধ করা যেতে পারে । কিছু আলোচনা করা হলো -

) জীবনধারা পরিবর্তন : স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়া এবং অ্যালকোহল সেবনকে এড়িয়ে চলার মতো অভ্যাসগুলি এর লক্ষণগুলির  অগ্রগতি বা মূল সমস্যাটির প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে ।

) ওষুধ : অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে, ভাইরাল হেপাটাইটিস বা উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো সমস্যাগুলির বিবেচনা করে ওষুধ নির্ধারণ করা প্রয়োজন । সুতরাং কোন পেশাদার চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয় । 

) পুষ্টির সহায়তা : একজন পেশাদার খাদ্য বিশেষজ্ঞ অপুষ্টি দূর করতে এবং লিভারের আরও ক্ষতি রোধ করতে খাদ্যতালিকার সামান্য পরিবর্তনের সুপারিশ করতে পারেন ।

) লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট : গুরুতর ক্ষেত্রে, যেখানে লিভারের কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হতে পারে।

লিভার সিরোসিস থেকে রক্ষা করার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

যদিও লিভার সিরোসিসের ক্ষেত্রে পেশাদার চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবুও কিছু কিছু ঘরোয়া প্রতিকার লিভারের স্বাস্থ্য এবং কার্যকারিতাকে বাড়াতে পারে এবং সিরোসিসের সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ তথা তাদের প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে ।

১) সবসময়  হাইড্রেটেড থাকুন : প্রচুর জল পান করা, লিভারকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে । দৈনিক অন্তত: আট গ্লাস জল খাওয়ার লক্ষ্য রাখা উচিত ।

২) সুষম খাদ্য গ্রহণ : টাটকা ফল, তাজা শাকসবজি, গোটা শস্য এবং ফ্যাটহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার লিভারের স্বাস্থ্য ও কার্যকারিতাকে সাহায্য করতে পারে । পালং শাক, ব্রকোলি, রসুন এবং অ্যাভোকাডোর মতো খাবার এই ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী ।

৩) প্রক্রিয়াজাত খাবার সীমিত করুন : অতিরিক্ত চিনি, অস্বাস্থ্যকর ফ্যাটযুক্ত ও লবণযুক্ত খবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া এড়িয়ে যান ।

৪) ভেষজ পরিপূরক : কিছু কিছু ভেষজ প্রতিকার ব্যবহার করতে পারেন, যেমন – অ্যালোভেরার জুস, ননীর জুস এবং রসুন ও হলুদের ব্যবহার সিরোসিসের ক্ষেত্রে লাভদায়ক হতে পারে । কিন্তু যেকোনো পরিপূরক শুরু করার আগে সবসময় একজন পেশাদার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী অথবা কোন পেশাদার ডায়েটেশিয়ানের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত ।

৫) নিয়মিত ব্যায়াম : নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সহায়তা করতে পারে।

৬) অ্যালকোহল গ্রহণ কমান : অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন কমানো বা অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকা লিভারের ক্ষতির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে।

৭) টক্সিন এড়িয়ে চলুন : ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ বা টক্সিন গ্রহণ কমান । তা সে যেমন ভাবেই হোক, খাদ্যের উপজাত হোক, শিল্পজাত দ্রব্যজাত টক্সিন যাই হোক না কেন ।

) নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা : নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপের মাধ্যমে লিভারের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা যেকোনো সমস্যাকে প্রাথমিকভাবে ধরতে সাহায্য করতে পারে।

লিভার সিরোসিস, লিভারের একটি গুরুতর সমস্যা-যার জন্যে সমসয়মতো নির্ণয় এবং চিকিৎসার প্রয়োজন । এর কারণ এবং উপসর্গগুলিকে বোঝা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার অভ্যাস তৈরী করা, সুষম খাদ্যগহণের অভ্যাস এবং কিছু ঘরোয়া প্রতিকারের ব্যবহার করা লিভারের সিরোসিসের চিকিৎসার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে । তবে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুসারে সমস্যা প্রতিরোধের জন্যে একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের পরামর্শ প্রয়োজন । আশা করি এই ব্লগ পোস্টটি লিভার সিরোসিস সম্পর্কে কিছুটা সচেতনতা আনতে সক্ষম হবে এবং সবার জন্যে সুস্থ থাকতে এবং সুস্থভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে । ব্লগ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ এবং যদি আপনি পোস্টের বিষয় এবং তথ্যগুলি পছন্দ করেন, তাহলে অনুগ্রহ করে অন্যদের জানাতে এবং তাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করার জন্য শেয়ার করুন । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ