স্পিরুলিনা : প্রকৃতির দেওয়া পুষ্টির পাওয়ার হাউস

 

আজকের দ্রুত-গতির বিশ্বে, মানুষ যখন ছুটে বেড়াচ্ছে দিনভর ব্যস্ততা ও রুটিনে বাঁধা জীবনযাপনে, সুস্থতা ও স্বাস্থ্যচিন্তা এবং তার জন্যে সময় দেওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এক মরীচিকা,  সেখানে স্পিরুলিনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক চিন্তামুক্তির আশ্বাস । স্পিরুলিনা এক সবুজ রঙের সুপারফুড,যা প্রধানত: শৈবাল বা এক বিশেষ প্রকার শ্যাওলা । এর অসামান্য পুষ্টি-গুণের জন্য স্বাস্থ্য-চিন্তা করেন এমন ব্যক্তিদের কাছে এটি প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । কিন্তু এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে এটি সম্পর্কে নলেজ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছে । কারণ, বিভিন্ন সময়ে এটি সম্পর্কে, এর স্বাদ নিয়ে, এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, ব্যবহারের নিরাপত্তা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে । তাই চলুন, আজ স্পিরুলিনার জগতে ঘুরে আসি এবং জানার চেষ্টা করি - স্পিরুলিনা কী, স্পিরুলিনা উদ্ভিদ সম্পর্কে, এর পুষ্টির প্রোফাইল এবং এর উপকারিতা, স্পিরুলিনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কাদের স্পিরুলিনা গ্রহণ করা উচিত নয় ইত্যাদি বিষয়গুলো ।

স্পিরুলিনা উদ্ভিদ : প্রকৃতির এক অসামান্য দান

স্পিরুলিনা হল একটি সর্পিল-আকৃতির, এককোষী জীব যা সায়ানোব্যাকটেরিয়া পরিবারের অন্তর্গত। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে আর্থ্রোস্পিরা প্ল্যাটেনসিস নামে পরিচিত । এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণের একটি, যা প্রধানত: ক্ষারীয় হ্রদ এবং পুকুরে সমৃদ্ধ হয় । বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় এর পুষ্টিগুণের জন্য এটিকে বিভিন্ন উপায়ে খাদ্য হিাসবে সমাদরে গ্রহণ করার ইতিহাস পাওয়া যায় । মাইক্রোস্কোপিক স্পাইরাল বা সর্পিল আকারের জন্য এর নাম হয়েছে স্পিরুলিনা । একই উপাদানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি গুণ সমৃদ্ধ একটি স্পেশাল বক্স হিসাবে এটি বর্তমান সমাজে একটি সুপারফুড বা খাদ্য সম্পূরক হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ।

স্পিরুলিনার চাষ

স্পিরুলিনার স্পন্দনশীল সবুজ রঙ এর মধ্যে থাকা উচ্চ ক্লোরোফিল সামগ্রীর জন্য দায়ী,  যা এটিকে শুধুমাত্র তার স্বতন্ত্র বর্ণ দেয় না বরং এর ডিটক্সিফাইং বৈশিষ্ট্যগুলিতেও অবদান রাখে । এই উদ্ভিদের মধ্যে একাধারে বিভিন্ন কার্বোহাইড্রেট, অ্যামাইনো অ্যাসিড, ভিটামিন, খনিজ দ্রব্য, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট দ্বারা সমৃদ্ধ । কিন্তু কৃত্রিমভাবে স্পিরুলিনার চাষ করা মোটেও সহজ কাজ নয় । সাধারণত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, যেমন পুকুর বা ট্যাঙ্কের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট রেখে এবং নির্দিষ্ট পি.এইচ মাত্রায়  চাষ করলে এটিকে চাষ করা যেতে পারে । যদিও এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ খুবই কম । সাধারণত: এই উদ্ভিদ ক্ষারীয় জলে বৃদ্ধি পায় । সোজা কথায়, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়, পুকুর বা ট্যাঙ্কের জলকে ঈষৎ ক্ষারীয় অবস্থায়, নির্দিষ্ট পি.এইচ মেনে এটিকে চাষ করা যেতে পারে । যেখানে এটি বৃদ্ধির বিভিন্ন অবস্থায় সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে শক্তি উৎপাদন করে এবং বিভিন্ন পুষ্টি-উপাদানে সমৃদ্ধ হয় ।

স্পিরুলিনা : একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ সুপারফুড

স্পিরুলিনার চেহারা অত্যন্ত সাধারণ বা দেখতে সুন্দর না হলেও গুণগত দিক থেকে অর্থাৎপুষ্টিগত বিচারে এটিকে পুষ্টি-উপাদানের এক অসামান্য ভান্ডার বললেও বোধহয় খুব কম বলা হবে । এই সুপারফুডে কি কি পুষ্টি-উপাদান দ্বারা সমৃদ্ধ এবং সেই সম্পর্কিত একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমরা এখানে করছি ।

১) প্রোটিন : স্পিরুলিনা প্রোটিন দ্বারা বিশেষভাবে সমৃদ্ধ, একটি আদর্শ প্রোটিনের মধ্যে যে নয়টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিাইনো অ্যাসিডের থাকা উচিত, তার সব কয়টি অ্যামাইনো অ্যাসিড এর মধ্যে বিদ্যমান । তাই স্পিরুলিনাকে্ একটি সম্পূর্ণ প্রোটিনের উৎস হিসাবে বিখ্যাত করে তুলেছে এবং বিশ্বের বহু স্বাস্থ্যমনস্ক মানুষ একটি প্রোটিনের সম্পূরক খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন । বিশেষত: নিরামিশাষীদের ক্ষেত্রে এবং যারা আমিষ প্রোটিন গ্রহণে বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য এটি একটি সুন্দর বিকল্প হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে ।

২) ভিটামিন এবং  খনিজ : স্পিরুলিনা বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান দ্বারা সমৃদ্ধ, যেমন - ভিটামিন এ, বি ভিটামিন (বি১, বি২, বি৩, বি৬, এবং বি১২ সহ), আয়রন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়ামে এটি ভরপুর, যা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য একটি বিস্তৃত পরিসর প্রদান করে।

৩) অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টস : স্পিরুলিনা মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির একটি শক্তিশালী উৎস । এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টউলির মধ্যে অন্যতমগুলি হলো -  ফাইকোসায়ানিন, ক্লোরোফিল, বিটা-ক্যারোটিন এবং টোকোফেরল, যা আমাদের শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং শরীরের কোষগুলিকে বিভিন্ন ক্ষতির হাত বাঁচাতে সাহায্য করে ।

৪) অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড : স্পিরুলিনার মধ্যে অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিডগুলির মধ্যে অন্যতম  ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে । যেগুলি আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর দিকগুলির, যেমন – মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য, কার্ডিওভাস্কুলার ফাংশন ঠিক রাখা এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের মতো দিকগুলিকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে ।

এখানে প্রতি ১০০ গ্রাম স্পিরলিনা পাউডারের পুষ্টি-মূল্যের একটি সাধারণ সারণী দেওয়া হলো : -

ক্রম নং	পুষ্টি উপাদানের নাম	পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে
১)	ক্যালোরি	২৯০ kcal
২)	প্রোটিন	৫৭ g
৩)	টোটাল ফ্যাট	৭.৭ g
৪)	স্যাচুরেটেড ফ্যাট	১.০ g
৫)	মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট	০.৯ g
৬)	পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট	১.৮ g
৭)	কোলেস্টেরল	০ mg
৮)	কার্বোহাইড্রেট	২৩ g
৯)	ডায়েটারী ফাইবার	৩.৬ g
১০)	সুগার	৩.১ g
১১)	ভিটামিন এ	০.০৮৬ g
১২)	ভিটামিন বি১ (থিয়ামিন)	২.৩৮ mg
১৩)	ভিটামিন বি২ (রাইবোফ্ল্যাভিন)	৩.৬৭ mg
১৪)	ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন)	১২.৮২ mg
১৫)	ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন)	০.৩৬ mg
১৬)	ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন)	২৮৩.০০ µg
১৭)	ভিটামিন সি	১০.১ mg
১৮)	ভিটামিন ডি	০.০০
১৯)	ভিটামিন ই	৫.০ mg
২০)	ক্যালসিয়াম	১২০ mg
২১)	আয়রন	২৮.৫ mg
২২)	ম্যাগনেশিয়াম	১৯৫ mg
২৩)	পটাশিয়াম	১.৩৬৩ mg
২৪)	সোডিয়াম	১০৪৮ mg
২৫)	জিঙ্ক	২.০ mg
২৬)	কপার	০.৫৭ mg
২৭)	ম্যাঙ্গানীজ	১.৯ mg
২৮)	সেলেনিয়াম	৭.০ mcg

   ** স্পিরুলিনার উৎস এবং তার প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে উপরোক্ত মানগুলির সামান্য পরিবর্তন হতে পারে ।

স্পিরুলিনার উপকারিতা 

স্পিরুলিনার মধ্যে থাকা পুষ্টি-উপাদান গুলি আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে চিত্তাকর্ষক ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম এবং সুনামের সঙ্গে সে সেই ভূমিকাগুলি পালন করে আসছে বলেই সুপারফুডগুলির মধ্যে সে এতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে । এর মধ্যে কতকগুলি বিষয় এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো ।

১) ইমিউন সাপোর্ট : স্পিরুলিনার মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে । তার ফল হিসাবে শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা  বৃদ্ধি পায় এবং সংক্রমণ ও অসুস্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।

২) এনার্জি বুস্ট : উস্পিরুনিার মধ্যে থাকা উচ্চ প্রোটিন সামগ্রী এবং এর মধ্যে থাকা আয়রনের মাত্রা শরীরের ক্লান্রির মোকাবিলা করে এনার্জির মাত্রা বাড়াতে পারে । এই কারণে এটি ক্রীড়াবিদ এবং ফিজিক্যালি অ্যাকটিভ ব্যক্তিদের জন্যে একটি জনপ্রিয় সুপারফুড হয়ে উঠেছে ।

৩) ডিটক্সিফিকেশন : স্পিরুলিনার মধ্যে থাকা ক্লোরোফিল উপাদানটি শরীরের মধ্যে প্রবেশ করা  ভারী ধাতু এবং টক্সিনগুলিকে বার করে দিতে সাহায্য করে । ফলে এটির গ্রহণে শরীর প্রাকৃতিক উপায়ে নিজেকে ডিটক্সিফাই করতে সক্ষম হয় এবং যার ফলে শরীর সামগ্রিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে ।

৪) হার্টের স্বাস্থ্য : বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্পিরুলিনা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল LDL কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, ফলে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুকি কমে যায় ।

৫) অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব : স্পিরুলিনার মধ্যে প্রচুর শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট থাকে, যা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি । এই সমস্ত অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টগুলি শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে । যার ফল হিসাবে আর্থ্রারাইটিসের মতো অবস্থাগুলির উপসর্গ থেকে উপশম পেতে সাহায্য করে ।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং সতর্কতা

স্পিরুলিনা যখন কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্যে উপযুক্ত মাত্রায় সেবন করা হয়, তখন সাধারণত বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে এটিকে নিরাপদ হিসাবে কাজ করতে দেখা গেছে , অত্যন্ত অল্প কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব বা পেট খারাপ, কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো হালকা কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন । সেই সব ক্ষেত্রগুলিতেও ডোজের হেরফের করলে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো গায়েব হয়ে যেতে দেখা গেছে । কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, যেমন – ফেনাইলকেটোনুরিয়া, অটোইমিউন ডিসঅর্ডারে ভুগছেন এমন ব্যক্তি, সামুদ্রিক খাবার বা আয়োডিনে অ্যালার্জি আছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্পিরুলিনা গ্রহণ এড়িয়ে চলা উচিত বা গ্রহণের আগে একজন নিউট্রিশনিস্ট বা ডায়েটেশিয়ানের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ।

স্পিরুলিনা তার অসামান্য পুষ্টি-ভান্ডার নিয়ে প্রকৃতির এক অসামান্য দান হিসাবে আমাদের সামনে এসেছে । সমগ্র বিশ্বে আজ এটি তার অসামান্য পুষ্টি-উপাদানের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে । শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আজ এটিকে নিয়ে আরো গবেযণা চলছে এবং এর বিভিন্ন উপকারী দিকগুলো ইতিমধ্যে বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থন লাভ করেছে । প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনসমৃদ্ধ্ এবং বি-ভিটামিনের একই সঙ্গে এক অনবদ্য সংযোগপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যে এটি মহিলাদের জন্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পূরক হিসাবে কাজ করে । যদিও স্পিরুলিনা গ্রহণে স্বাস্থ্যহানি বা জীবনহানির মতো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ইতিহাস আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তবুও দৈনন্দিন রুটিনে এটিকে ঢোকানোর আগে কোন ডায়েটেশিয়ান বা নিউট্রিশনিস্টের সঙ্গে একবার আলোচনা করে নেওয়া উচিত ।